Saturday 29 January 2011

বিএসএফ গুলি করার পর কাঁটাতারে ৫ ঘণ্টা ঝুলে ছিল ফেলানির লাশ : অধিকারের রিপোর্ট


বিশেষ প্রতিনিধি

কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরীতে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। গতকাল রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অধিকারের মানবাধিকার কর্মীরা ফেলানীর বাবা, চাচা, বিজিবির কোম্পানি কমান্ডার, ব্যাটালিয়ান অধিনায়ক, পুলিশ কর্মকর্তাসহ সরেজমিন সংশ্লিষ্টদের সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে। অধিকারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় ফেলানীর কাপড় তারে আটকে যায়। এতে ভীত হয়ে সে চিত্কার করে ওঠে। এ অবস্থায় বিএসএফ খুব কাছে থেকে বুকে গুলি করে ফেলানীকে হত্যা করে। ৭ জানুয়ারি সকাল প্রায় ৬টায় কুড়িগ্রাম জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা নাগেশ্বরীর দক্ষিণ রামখানা গ্রামের অনন্তপুর সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর প্রায় ৫ ঘণ্টা ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলেছিল। পরে সকাল ১১টার দিকে লাশ খুলে নিয়ে যায় বিএসএফ।
অধিকারকে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম জানান, বিএসএফের কাছ থেকে লাশ ফিরে পেলেও ফেলানীর সঙ্গে থাকা স্বর্ণালঙ্কার ফেরত পাননি তিনি। ফেলানীর মা নিজ হাতে মেয়ের বিয়ের গয়না পরিয়ে দিয়েছিলেন। সীমান্ত অতিক্রমকালে ফেলানীর কানে দুল, নাকে নোলক এবং হাতে সোনার চুড়ি ছিল। অল্প অল্প করে জমানো টাকা দিয়ে মেয়ের বিয়ের জন্য গয়না তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিএসএফের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে অকালে প্রাণ হারালো ফেলানী। এ ঘটনার পর নুরুল ইসলাম অধিকারকে বলেন, তিনি আর ভারতে যেতে চান না এবং তার স্ত্রী ও অন্য সন্তানদের বাংলাদেশে এনে এখানেই বসবাস করতে চান।
কাশিপুর বিজিবি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার আবদুল জব্বার বলেন, বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ কিশোরী ফেলানীর ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনাটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের ঘটনার জন্য বিএসএফ কোনোরকম দুঃখ প্রকাশ করেনি।
২৭ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুর রাজ্জাক তরফদার জানান, বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের জন্য বিজিবির পক্ষ থেকে কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে এবং ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ের আলোচনায় বিএসএফের কাছে এ ব্যাপারে কৈফিয়ত চাওয়া হবে। এটি শুধু আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন নয় বরং মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন।
ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম অধিকারকে বলেন, তিনি ভারতের আসামের বংগাইগাঁও, টুনিয়াপাড়া, ভাওয়ালকুড়ি নামের জায়গায় তার স্ত্রী, ৩ মেয়ে ও ৩ ছেলে নিয়ে বসবাস করতেন। ৬ সন্তানের মধ্যে ফেলানী ছিল সবার বড়। নুরুল ইসলাম বাবার মৃত্যুর পর তার মা ও তিন ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। অভাব-অনটনের কারণে নুরুল ইসলাম অনেক ছোট বয়সে আসামে চলে যান। সেখানে তিনি রিকশা চালিয়ে, ইটভাটায় কাজ করে জীবনযাপন করতেন। পরে নিজের দেশে কুড়িগ্রামে এসে বিয়ে করেন। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে আসামের বংগাইগাঁওয়ে চলে যান। সেখানেই তার সব সন্তানের জন্ম হয়। সেখানে তার একটি পানের দোকান আছে, যা তার স্ত্রী পরিচালনা করেন। ঘটনার প্রায় ৫-৬ মাস আগে নুরুল ইসলাম বাংলাদেশে এসে তার বড় মেয়ে ফেলানীর বিয়ে ঠিক করেন লালমনিরহাটের কুলাঘাটে ফেলানীর খালাতো ভাই মো. আমজাদ আলীর সঙ্গে। ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টে কাজ করেন। বিয়ের দিন ছিল ৮ জানুয়ারি ২০১১। মেয়ের বিয়ের জন্য ভারতের আসাম থেকে বাংলাদেশে মেয়েকে নিয়ে সীমান্ত পারাপারের জন্য তিনি ভারতীয় চোরাকারবারি মোশারফ হোসেন ও বুজরতের সঙ্গে ভারতীয় ৩০০০ রুপিতে চুক্তি করেন। এর জন্য তিনি ও তার মেয়ে ফেলানী গত ৬ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে মোশারফের বাড়িতে আসেন। এরপর রাত ১টায় মোশারফ তাদের নিয়ে কিতাবেরকুঠি সীমান্ত এলাকার কাঁটাতারের কাছাকাছি চলে আসে কিন্তু সুযোগ না পাওয়ায় চোরাকারবারি তাদের পারাপার করাতে দেরি করে। এভাবে সময় পার হতে থাকে এবং ভোর হতে শুরু করে। ফজরের নামাজের আজানের পর চোরাকারবারি মোশারফ নুরুল ইসলামকে সীমান্ত অতিক্রম করতে বলে। কিন্তু এ সময় তিনি পার হতে অনীচ্ছা প্রকাশ করলেও চোরাকারবারি মোশারফ তাদের জোর করেই মইয়ের মাধ্যমে কাঁটাতারের বেড়া পার করানোর উদ্যোগ নেয়। নুরুল ইসলাম বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও মোশারফ তাকে ঠেলে মইয়ে তুলে দেয়। তা না হলে তিনি আর কাঁটাতারের বেড়া পার হতে পারবেন না এবং তার টাকাও ফেরত দেয়া হবে না। একরকম বাধ্য হয়েই তিনি ফেলানীকে সঙ্গে নিয়ে কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করতে বাঁশের মইয়ে ওঠেন। নুরুল ইসলাম সফলভাবে কাঁটাতার পার হয়ে মইয়ের অপরপ্রান্তে চলে আসতে পারলেও ফেলানী মইয়ের মাঝপথে এলে একপর্যায়ে তার জামা কাঁটাতারের সঙ্গে আটকে গেলে সে ভয়ে চিত্কার শুরু করে। চিত্কারের শব্দ শুনে পাশে টহলরত বিএসএফ সদস্য কাঁটাতারের বেড়ার কাছে এসে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। গুলিটি ফেলানীর ডান বুকের ওপরের দিকে বিদ্ধ হলে ফেলানী কাঁটাতারের মধ্যে ঝুলে পড়ে। এ সময় নুরুল ইসলাম জীবন বাঁচাতে হামাগুড়ি দিয়ে মই থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কাঁটাতারের আঁচড়ে তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তিনি চিত্কার করে মেয়েকে ডাকতে থাকেন। এ সময় বিএসএফ সদস্যরা তাকেও গুলি করতে উদ্যত হলে তিনি জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন এবং কিছুদূর গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
কাশিপুর বিজিবি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার আবদুল জব্বার অধিকারকে জানান, গত ৭ জানুয়ারি আনুমানিক ৬টা ১৫ মিনিটে সংঘটিত ফায়ারের পরপরই অনন্তপুর বিওপির বিজিবি টহলদল ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে বিজিবি সদস্যরা তত্ক্ষণাত্ ফেলানীর লাশ দেখতে পায়নি। পরে সকাল ১০টা ৩০টার দিকে বিজিবি টহল দল কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে নিহত ফেলানীর লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। ওইদিন সকাল ১০টা ৫০টার সময় বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া থেকে নিহত ফেলানীর লাশ সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের জন্য ভারতের কুচবিহারে নিয়ে যায়। আনুমানিক সকাল ১১টায় কোম্পানি কমান্ডার নায়েব সুবেদার মো. আবদুল জব্বার নিহতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর লাশ ফেরত চেয়ে বিএসএফের কাছে চিঠি পাঠান এবং তাদের পতাকা বৈঠকে বসার অনুরোধ জানান। কিন্তু বিএসএফের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ৮ জানুয়ারি সকাল ১১টায় বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠক শুরু হয় এবং সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে পতাকা বৈঠক শেষে বিএসএফ প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর নিহত ফেলানীর লাশ হস্তান্তর করে। পতাকা বৈঠকে তার নেতৃত্বে অনন্তপুর বিওপি ইনচার্জ হাবিলদার সানাউল্লাহসহ ১৩ জন বিজিবি সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে বিএসএফের পক্ষে নেতৃত্ব দেন কোম্পানি কমান্ডার রামব্রীজ রায়। এ সময় ভারতীয় পুলিশসহ ৩০ জন বিএসএফ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী থানার এসআই নুরুজ্জামান অধিকারকে বলেন, বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠককালে তিনি উপস্থিত থেকে ভারতীয় সংশ্লিষ্ট পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে লাশ গ্রহণ করেন। পরে এ ব্যাপারে ফুলবাড়ী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং ০১/১১, তারিখ ০৮/১/১১ইং সময়-১৩.২৫ ঘটিকা।
কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতলের আরএমও ডা. মো. নজরুল ইসলাম অধিকারকে বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রথমে লাশের ময়নাতদন্ত করেছে। ৯ জানুয়ারি হাসপাতাল লাশটি পাওয়ার পর ৩ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দল গঠন করা হয়। দুপুর ২টায় ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ১টি গুলি ফেলানীর বুকের ডানদিকে বিদ্ধ হলে গুলিটি ফেলানীর পাঁজরের পেছন দিয়ে বের হয়ে যায় বলে তিনি জানান।
২৭ বিজিবি ব্যাটালিনের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুর রাজ্জাক তরফদার অধিকারকে জানান, লাশটি একজন বাংলাদেশীর এটা জানার পর ১৮১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্ট এসএইচ মানিদ্র সিংয়ের সঙ্গে ৭ জানুয়ারি আনুমানিক ১২টায় টেলিফোনে কথা বলে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং লাশ ফেরত দেয়ার জন্য কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে সহযোগিতা দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। উভয়পক্ষের কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠকে বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফ কর্তৃক সংঘটিত ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয়।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ৭৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করে। সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের হত্যা আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন। অধিকার দাবি জানাচ্ছে, সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং যে কোনো ঘটনার তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে

No comments:

Post a Comment