দিলরুবা সুমী
আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ছাপানো প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ১৭ লাখ কপি বিনামূল্যের বই এখন পর্যন্ত দিতে পারেনি কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) গতকালের তথ্যানুযায়ী ভারত থেকে ছাপিয়ে আনা বইগুলোর মধ্যে এখনও ৬ লাখ কপি দেশে আসেনি। দেশে কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন পর্যন্ত ১১ লাখ কপি বই দিতে পারেনি। অথচ শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া সর্বশেষ সময় অনুযায়ী গত ২১ ডিসেম্বর এসব বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানোর কথা ছিল।
এসব বইয়ের বেশিরভাগ আপদকালীন সময়ের জন্য সংরক্ষণ বা বাফার স্টকের বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বিভিন্ন নামে ক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ নেয়ায় দেশের একটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এবং যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ভারতের একটি প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত বই দিতে পারেনি। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর এবং মাধ্যমিকের প্রায় সব বই এরই মধ্যে দেশের প্রায় সব স্কুলে চলে গেছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, এ বছর প্রথম থেকে দশম শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যের বোর্ডের বই দিতে সরকার ২৩ কোটি ২০ লাখ বই ছাপিয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর প্রায় ৫ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে। এর প্রায় ৩ কোটি ভারতের দুটি এবং বাকি বই দেশের তিনটি প্রতিষ্ঠান ছাপানোর কাজ পেয়েছে। গত ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক উত্সব দিবসে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, দেশের সব শিক্ষার্থীর হাতে বই দিতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে। সে হিসেবে আগামী শুক্রবার এই সময় শেষ হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের মোট বইয়ের এক ভাগেরও অনেক কম বই যথাসময়ে জেলা পর্যায়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। মুদ্রণকারীরা জানান, যান্ত্রিক কিছু সমস্যার কারণে যেসব বইয়ের ছাপা খারাপ হয়েছে বা পাতা ছিঁড়ে গেছে সেগুলো খুঁজে বের করে এখন ছাপানো হচ্ছে। এটা কালকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সভাপতি মো. তোফায়েল খান বলেন, এনসিটিবি যথাসময়ে আমাদের কাগজ, পজিটিভ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিদ্যুত্ সমস্যা ছিল মারাত্মক। তারপরও আমরা দেশীয় মুদ্রণকারীরা যথাসময়ে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের সব বই জাতীয় স্বার্থে শিক্ষাবর্ষের শুরুতে দেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। সফলও হয়েছি। কিন্তু আমাদের আক্ষেপ হলো, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত বছরের শুরুতে যে উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে বই ছাপিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিল শর্ত অনুযায়ী সেসব বইয়ের মান যথার্থ হয়নি। এমনকি যথাসময়ে বইপ্রাপ্তি নিশ্চিত হয়নি। এ কারণে যেসব শিশু জীবনে প্রথম স্কুলে গিয়েছে তাদের অনেকেই বছরের প্রথম দিন বই পায়নি। অথচ তার স্কুলের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা বই পেয়েছে। এটা শিশুদের মানসিকভাবে কষ্ট দিয়েছে। এটা আমাদের জন্যও বেদনাদায়ক।
বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবদুল আউয়াল তালুকদার জানান, গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সরকারি স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি শ্রেণীতেই একটি, দুটি করে বিষয়ের বই বাকি আছে। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর বইগুলোর কাগজের মান আগের চেয়ে ভালো হলেও ছাপার মান তত ভালো নয় বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ প্রি-ক্যাডেট অ্যান্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. রেজাউল হক জানান, সমিতির অন্তর্ভুক্ত প্রায় দেড় হাজার স্কুলের বেশিরভাগই গতকাল পর্যন্ত সব বই পায়নি। সপ্তম শ্রেণীর ইংরেজি বইটি চাহিদার চেয়ে সব স্কুলই কম পেয়েছে। তার নিজের নিউ লাইফ ক্যাডেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ গতকাল পর্যন্ত তৃতীয় শ্রেণীর একটি বইও পায়নি। আগামীকাল উপজেলা শিক্ষা অফিসে তাকে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণীর বিজ্ঞান বইটি বাকি আছে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি নুরুল আবছার বলেন, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর দু’একটি করে বিষয়ের বই বাকি আছে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর ধর্ম বিষয়ের বই কিছু বাকি আছে।
এদিকে এনসিটিবির পাঠ্যবই বিতরণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ কর্তকর্তা অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী গতকাল আমার দেশ-কে জানান, যারা বই বেশি নিয়েছিল তারা এখন শাস্তির ভয়ে ফেরত দিচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় সবই ঢাকা মহানগরীর। গত ২ জানুয়ারি রোববার থেকে গতকাল পর্যন্ত তিন দিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল থেকে প্রায় ১ লাখ বই ফেরত এসেছে। আগামীকাল পর্যন্ত অতিরিক্ত বই ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যারা নির্দিষ্ট সময়ে অতিরিক্ত বই ফেরত না দেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর মধ্যে সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে সাময়িক বরখাস্ত, ওএসডি বা বদলি করা হতে পারে। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এমপিও বন্ধ করা হবে। আর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বাতিল করা হবে।
অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী আরও জানান, সম্প্রতি ৩০৫টি প্রতিষ্ঠান বইয়ের চাহিদাপত্র দিয়েছে। নতুন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রাজধানীতেই আছে ২৮৬টি। এছাড়া সাভারে ১৬টি ও রাজবাড়ীর তিনটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে বই দেয়া হচ্ছে। গত তিন দিনে ঢাকা মহানগরীর নতুন ১৫৯টি স্কুলে প্রায় ১ লাখ বই বিতরণ করা হয়েছে। তবে পরিদর্শনে কয়েকটি স্কুল ভুয়া বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
No comments:
Post a Comment