Wednesday 29 December 2010

বাংলাদেশকে শতকোটি টাকা ঠকিয়ে ওয়ারিদ কিনেছে এয়ারটেল : দেশের টেলিকম খাতকে ভারতীয়করণের চক্রান্ত চলছে

জিয়াউদ্দিন সাইমুম

শুরুতেই বাংলাদেশকে শতকোটি টাকা ঠকিয়ে ওয়ারিদ টেলিকম কিনেছে ভারতী এয়ারটেল। অন্যদিকে ওয়ারিদ টেলিকম কেনার মাধ্যমে শুধু ভারতী এয়ারটেলই সুবিধা পায়নি, টেলিকম খাতে নতুন চাকরি সৃষ্টির নামে ভারত বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় টেলিকম খাতকে ভারতীয়করণেরও সুযোগ পেয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রান্সপোর্ট, গার্মেন্ট, ইলেকট্রনিক্স, ওষুধ, খাদ্যপণ্য, পানীয়সহ বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ থাকলও টেলিকম সেক্টরে এটাই প্রথম। এদিকে বছরশেষে বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়বে বৈ কমবে না। আর এয়ারটেল সে ঘাটতির ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
অভিযোগ রয়েছে, ভারতকে এ সুযোগটি করে দেয়ার পেছনের ব্যক্তি দু’জন হচ্ছেন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহাম্মেদ রাজু এবং বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ। কারণ ওয়ারিদ টেলিকমের শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে এ দু’জন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ওয়ারিদের মোট মূল্য ১ কোটি টাকা দেখিয়ে মাত্র ৭০ লাখ টাকার বিনিময়ে ওয়ারিদ টেলিকমের ৭০ ভাগ শেয়ার কিনে নেয়ার সুযোগ করে দেন এয়ারটেলকে। তবে টেলিকম বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর পেছনে প্রশাসনের বড় কোনো কর্মকর্তার পরোক্ষ মদত থাকতে পারে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১-এর ধারা ৩৭(১) অনুসারে বিটিআরসি থেকে লাইসেন্স পাওয়া কোনো কোম্পানি অন্য কোনো কোম্পানির কাছে লাইসেন্স বিক্রি করতে পারবে না; কিন্তু ৩৭(৩)-এর ঝ উপধারা অনুসারে শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে। এই শেয়ার হস্তান্তরের সময় শেয়ারমূল্যের ৫.৫ ভাগ বিটিআরসিকে দিতে হবে। ওয়ারিদের ৭০ ভাগ শেয়ারের মূল্য ৩০ কোটি টাকা দেখালে এর ৫.৫ ভাগ অর্থাত্ ১১৫.৫ কোটি টাকা বিটিআরসিকে দিতে হতো। কিন্তু ৭০ শতাংশ শেয়ারের দাম নামমাত্র ৭০ লাখ টাকা দেখানোর কারণে দিতে হয়েছে ৭০ লাখ টাকার ৫.৫ ভাগ অর্থাত্ মাত্র ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে—এই আশঙ্কায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় পরবর্তী সময়ে এ আইনটিই পরিবর্তন করে ফেলে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানির নামে সবচেয়ে বেশি শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে ওয়ারিদ টেলিকম লিমিটেড, যা এখন এয়ারটেলের নামে চলছে। এক তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকা কাস্টমস হাউস দিয়ে আমদানি করা ১৫টি চালানে ওয়ারিদ টেলিকম এ পর্যন্ত ৬৯ কোটি ৬২ লাখ ৬৮ হাজার টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমদানি চালান আটক করে পুনরায় কায়িক পরীক্ষা করা হলে মিথ্যা ঘোষণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের শুল্ক ফাঁকির ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়। পরে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হলে শুনানির পর ঢাকা কাস্টমস কমিশনারের বিচারাদেশে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় ১৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এর বিরুদ্ধে ওয়ারিদ কাস্টমস আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করেছে বলে জানা গেছে।
গত ২০ ডিসেম্বর হয়ে গেল এয়ারটেলের লোগো উন্মোচন তথা খোলস পরিবর্তন পর্ব। নতুন স্লোগান ‘ভালোবাসার টানে, পাশে আনে’ নিয়ে তাদের লক্ষ্য ২০১৫ সালের মধ্যে এয়ারটেলকে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ব্যবহারকারীর ভালোবাসাসিক্ত ব্র্যান্ডে পরিণত করা।
ওয়ারিদের যাত্রা শুরু হয়েছিল পহেলা বৈশাখে। এদেশের সংস্কৃতি ও লৌকিকতা তুলে ধরে চিত্রায়িত বাপ্পা মজুমদারের ‘সালাম বাংলাদেশ’ গানের মাধ্যমে। কিন্তু এয়ারটেলের প্রথম বিজ্ঞাপনটি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তো নয়ই, বরং বিজ্ঞাপনটি দেখে যে কারও ধারণা হতে পারে, এটি ভারতে চিত্রায়িত এবং ভারতীয় মডেল দ্বারা অভিনীতও বটে। ইউনিলিভারের কল্যাণে ইতোমধ্যেই দেশীয় চ্যানেলে ভারতীয় নায়ক-নায়িকাদের মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে। শাহরুখ খানের পদধূলির সুবাদে ডেসটিনির চ্যানেল বৈশাখী একমাস অনবরত হিন্দি গানের আসর বসিয়েছিল। এখন সেই যাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে এয়ারটেল।
এয়ারটেল শুধু ভারতীয় মডেল দিয়ে বিজ্ঞাপন করেই ক্ষান্ত থাকেনি, তাদের লঞ্চিং বোনাঞ্জার প্রথম পুরস্কার হিসেবে তারা রেখেছে বলিউড সেলিব্রেটি জুটি সাইফ এবং কারিনার সঙ্গে ডিনারের সুযোগ। দৈনিক আমার দেশ-এর একজন পাঠকের ভাষায়, ‘ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বাদে অন্য কোনোভাবে ব্যাপারটিকে নিতে পারলাম না।’
এয়ারটেল শুরুতেই ঘোষণা দিয়েছে তারা বাংলাদেশে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। কিন্তু টেলিকরিডোর নিয়ে এয়ারটেলের দৌড়ঝাঁপ দেখে এ খাতের বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা হচ্ছে, এয়ারটেল বাংলাদেশের বিকাশমান টেলিকম খাতকে ভারতীয়করণের চেষ্টা করছে।

No comments:

Post a Comment