Tuesday, 26 April 2011

সীমান্তে শিশুসহ দুজনকে হত্যা করল বিএসএফ











সামিউল মনির শ্যামনগর (সাতক্ষীরা)
সাতক্ষীরার গাজীপুর সীমান্তে এবার এক শিশুসহ দুই বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। নিহত রাখাল শিশু রেকাতুল ইসলামের লাশ পাওয়া গেলেও অপর একটি লাশ নিয়ে গেছে বিএসএফ সদস্যরা। বিএসএফের নির্বিচার গুলিতে আহত হয়েছেন আরও অনেকে। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ দুজনকে গুরুতর অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বহুবার সীমান্তে হত্যা বন্ধ রাখার আশ্বাস দিয়েছে ভারত। কিন্তু সে আশ্বাস কোনোই কাজে আসছে না। বিএসএফের গুলিতে কুড়িগ্রাম সীমান্তে কিশোরী ফেলানীর নির্মম মৃত্যুর পর ভারত সরকার কথা দিয়েছিল তারা আর সীমান্তে গুলি চালিয়ে কাউকে হত্যা করবে না। সীমান্তহত্যা শূন্যের কোটায় আনারও আশ্বাস দেয়া হয়। এমনকি প্রয়োজনে রাবার বুলেট ব্যবহারেরও ঘোষণা দেয়া হয়; কিন্তু কথা রাখেনি বিএসএফ।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরা সীমান্ত সংলগ্ন কলাপোতা এলাকায় গতকাল নিহত বাংলাদেশী শিশু রেকাতুল ইসলাম (১৫) সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার বসন্তপুর গ্রামের মুনছুর গাজীর ছেলে। সে পেশায় দিনমজুর। অপর নিহতের পরিচয় জানা যায়নি। কারণ নির্বিচারে গুলির পর যে যেদিকে পেরেছে পালিয়ে গেছে। তবে একটি মৃতদেহ বিএসএফ সদস্যরা উদ্ধার করে বশিরহাট থানায় নিয়ে গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। আহত যে দুজনকে পাওয়া গেছে, তারা হলেন কালিগঞ্জ উপজেলার মাঘুরালি গ্রামের পোটাল মিঞার ছেলে শাহাদাত হোসেন (২৪) ও শ্যামনগর উপজেলার জাবাখালী গ্রামের ইমান আলী মোল্লার ছেলে আজিজুল ইসলাম (৪২)।
জানা যায়, শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী গ্রামের মোমিন গাজীর ছেলে রফিকুল ইসলাম সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী লক্ষ্মীদাঁড়ি গ্রামের সাবুরালীর বাড়িতে অবস্থান করে ভারত থেকে বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের গরু আনতে সহায়তা করে থাকে। রফিকুল রোববার সন্ধ্যায় গাজীপুর সীমান্ত দিয়ে রেকাতুল ইসলাম, শাহাদাত হোসেন, আজিজুল ইসলাম ও তারাসহ ২৮ জনকে ভারতে গরু আনতে পাঠায়। গরু নিয়ে ফেরার সময় গতকাল ভোর সাড়ে চারটার দিকে গাজীপুর সীমান্তের ৫ নং মেইন পিলারের ৬ নং সাবপিলারের বিপরীতে জিরো পয়েন্ট থেকে ভারতের ২০০ গজ ভেতরে কলাপোতা গ্রামে হেলাতলা ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে কমপক্ষে আট রাউন্ড গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই রেকাতুলসহ দু’জনের মৃত্যু হয়। রেকাতুলকে জিরো পয়েন্টে ফেলে গেলেও বিএসএফ অপর নিহত গরুর রাখালকে বশিরহাট থানায় নিয়ে যায়। শাহাদাত হোসেন ও আজিজুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে জিরো পয়েন্টে পৌঁছলে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাদের খুলনার ২৫০ শয্যা হাসপাতালের উদ্দেশে পাঠানো হয়। নিহত রেকাতুলের লাশ জিরো পয়েন্ট থেকে এনে তার বাবা মুনছুর গাজীর কাছে তুলে দেয়া হয়।
কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিন সাতক্ষীরা সদর উপজেলা সীমান্তের ভোমরা এলাকার বিপরীতে বিএসএফের গুলিতে রেকাতুল ইসলাম নিহত ও শাহাদাত হোসেনের জখম হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, নিহত রেকাতুলের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। আহত শাহাদাতকে খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ভোমরা বিজিবি ক্যাম্পের নায়েব সুবেদার আবদুল আজিজ তার এলাকার বিপরীতে ভারতে এ ধরনের কোনো রাখাল গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বা আহত হওয়ার কথা অস্বীকার করেন।
এদিকে আমাদের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিন তাকে আরও জানিয়েছেন, সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্ত দিয়ে রেকাতুল গাজীসহ কয়েকজন যুবক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গরু আনতে যায়। গতকাল ভোরে গরু নিয়ে ফেরার পথে ভারতের বেলেডাঙ্গা সীমান্তে বিএসএফের গুলির মুখে পড়ে তারা। এ সময় বিএসএফ বাংলাদেশীদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। গুলিবিদ্ধ যুবকদের মধ্যে আহত রেকাতুল গাজীকে বাড়িতে আনার পথে সে মারা যায়। সাতক্ষীরা ৪১ বর্ডার গার্ডের অধিনায়ক লে. কর্নেল এনায়েত করিম জানান, বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশী যুবক নিহতের কথা শুনেছেন।
এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে গত ২৭ মাসে ১৩৬ বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। তিনি জানান, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত মার্চ পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ১৩৬ (২০০৯-এ ৬৭ জন, ২০১০-এ ৬০ জন ও চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত ৯ জন) বাংলাদেশী নিহত ও ১৭০ জন আহত হন। সাহারা খাতুন বলেন, মার্চে সীমান্ত সম্মেলনে বিএসএফ ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তে পরীক্ষামূলকভাবে রাবার বুলেটের মতো নন-লেথাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়—এমন অস্ত্র) ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ভারত সরকার এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে বিএসএফ সদস্যদের মধ্যে রাবার বুলেট সরবরাহও করেছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ায় সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমে এসেছে দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে উভয় দেশ কাজ করছে।

নববর্ষে বিএসএফের উপহার এক বাংলাদেশীর লাশ











স্টাফ রিপোর্টার
নববর্ষে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশী নিহত ও অপর একজন আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার ভোরে যশোর জেলার বেনাপোলের সাদীপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত ওই যুবকের নাম মুন্না (১৮) ও আহতের নাম মামুন (২৩)। নিহত মুন্না বেনাপোলের বড়আঁচড়া গ্রামের খোকনের ছেলে ও মামুন নামাজ গ্রামের দীন মোহাম্মদ দীনুর ছেলে। এদিকে বিজিবি বলছে বিএসএফের গুলিতে একজন গুলিবিদ্ধ হলেও কেউ মারা যায়নি। গুলিবিদ্ধ আহত ব্যক্তির নাম মনা। বিজিবির পক্ষ থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
আমাদের বেনাপোল প্রতিনিধি ও বাংলা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে, বিএসএফ গুলি করে মুন্নার লাশ টেনেহিঁচড়ে ভারতের ভিতরে নিয়ে গেছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিএসএফ মুন্নার লাশ হস্তান্তর করেনি। ঘটনাস্থল থেকে বিজিবি ৬টি গরু উদ্ধার করেছে।
বেনাপোল পোর্ট থানার এস আই সিরাজুল ইসলাম জানান, ‘বৃহস্পতিবার ভোরে বেনাপোলের সাদীপুর সীমান্তের লেবুতলা পোস্ট দিয়ে ১০/১২ জন ব্যবসায়ী গরু নিয়ে ভারতের জয়ন্তীপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ফিরছিলেন। এ সময় প্যাট্রাপুল
জয়ন্তীপুর ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে ৮/১০ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়। মামুনের বুক ও পায়ে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মামুন বাংলাদেশ সীমান্তের ভিতরে চলে আসতে সক্ষম হয়। তাকে প্রথমে যশোর ও পরে খুলনা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। অপরজনের অবস্থা জানাতে পারেননি তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গুলিবিদ্ধ মুন্না ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল তিনি আহত হয়েছেন। পরে জানা গেছে তিনি মারা গেছেন। সাদীপুর গ্রামের সুলতান আহমেদ মেম্বার জানান, গরু ব্যবসায়ীরা সীমান্ত পার হওয়ার সময় বিএসএফ ছয় রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে দু’জন আহত হয়। এদের মধ্যে একজনকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে। অন্যজনের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে বিজিবির ২২ ব্যাটালিয়ন প্রধান লে. কর্নেল হাসিব আলম গতরাতে আমার দেশকে জানান, তার জানামতে বিএসএফের গুলিতে একজন আহত হয়েছে। তার নাম মনা মিয়া। তার পা ও বুকে গুলি লেগেছে। তাকে প্রথমে যশোর ও পরে খুলনায় চিকিত্সার জন্য পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, গতকাল দুপুরেও বিএসএফের ৩৬ ব্যাটালিয়ন কমান্ড্যান্ট অনিল কুমার সিনহার সঙ্গে তার টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি কোনো বাংলাদেশী নিহত হওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।
বিএসএফের পক্ষ থেকে বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধে বহুবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে রাবার বুলেট ব্যবহারসহ বিকল্প ব্যবস্থার কথা। কিন্তু ওইসব প্রতিশ্রুতি বরাবরই ভঙ্গ করে বাংলাদেশের নাগরিকদের গুলি ও হত্যা করে চলেছে বিএসএফ। নববর্ষের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের নাগরিকের ওপর গুলিবর্ষণ করায় বেনাপোল সীমান্তে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

আশ্বাস দেয়ার পরও সীমান্তে বিএসএফের হত্যাযজ্ঞ : রাজশাহী সীমান্তে গুলিতে এক বাংলাদেশী নিহত

নাসির উদ্দিন শোয়েব

সীমান্তে হত্যা চলছেই। কথা রাখছে না ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ)। দু’দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বহুবার সীমান্তে হত্যা বন্ধ রাখার আশ্বাস দিয়েছে ভারত। কিন্তু সে আশ্বাস কোনোই কাজে আসছে না। বিএসএফের গুলিতে কুড়িগ্রাম সীমান্তে কিশোরী ফেলানীর নির্মম মৃত্যুর পর ভারত সরকার কথা দিয়েছিল তারা আর সীমান্তে গুলি চালিয়ে কাউকে হত্যা করবে না। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় আনারও আশ্বাস দেয়া হয়। এমনকি প্রয়োজনে রাবার বুলেট ব্যবহারেরও ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু কথা রাখেনি বিএসএফ। আবারও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এক বাংলাদেশীকে।
আমাদের রাজশাহী অফিস জানায়, জেলার পবা উপজেলার সোনাইকান্দি সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে সোমবার গভীর রাতে আলমগীর হোসেন কালু (৩০) নামের এক বাংলাদেশী নাগরিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তবে তার নাগরিকত্ব নিয়ে বিজিবি ও পুলিশ ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। বিজিবি জানায়, নিহত ব্যক্তি ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার রানীনগর থানার বাশগাটা গ্রামের দেরাজ হোসেনের ছেলে। তবে পবা থানা পুলিশ জানায়, নিহত ব্যক্তি পবা উপজেলার বেড়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার লাশ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্বজনরা নিয়ে গেছেন। এ ঘটনা নিয়ে বিজিবি ভুল তথ্য দিয়েছে বলে পুলিশের দাবি। হাসপাতালের রেজিস্টারেও তার নাম-ঠিকানায় বাংলাদেশী উল্লেখ করলেও বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সে ভারতীয় নাগরিক। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সোনাইকান্দি বিওপির কোম্পানি কমান্ডার জানান, সোমবার রাত ১টার দিকে সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির পর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আলমগীর এপারে (বাংলাদেশে) পালিয়ে আসে। সোনাইকান্দি এলাকার বিওপি সদস্যরা তাকে আহত অবস্থায় রাতেই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। রাত ৩টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
রাজশাহী ৩৯ বিজিবির কমান্ডিং অফিসার গাজী মোহাম্মদ খালিদ জানান, বিষয়টি তারা শুনেছেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পবা থানার উপ-পরিদর্শক নজরুল ইসলাম জানান, নিহত ব্যক্তি পবা উপজেলার বেড়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার আত্মীয়রা হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে গেছেন।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বলেছিলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে গত ২৭ মাসে ১৩৬ বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। তিনি জানান, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত মার্চ পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ১৩৬ (২০০৯-এ ৬৭ জন, ২০১০-এ ৬০ জন ও চলতি বছর ১৪ মার্চ পর্যন্ত ৯ জন) বাংলাদেশী নিহত ও ১৭০ জন আহত হয়। সাহারা খাতুন বলেন, মার্চে সীমান্ত সম্মেলনে বিএসএফ ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তে পরীক্ষামূলকভাবে রাবার বুলেটের মতো নন লেথাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়—এমন অস্ত্র) ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভারত সরকার এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে বিএসএফ সদস্যদের মধ্যে রাবার বুলেট সরবরাহও করছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ায় সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমে এসেছে দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে উভয় দেশ কাজ করছে।
সূত্র জানায়, ভারতীয় কোনো আশ্বাসই বাস্তবে প্রতিফলিত হয় না। দু’দেশের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পরও আগ্রাসী মনোভাব অব্যাহত রয়েছে। তারা নতুন নতুন কৌশলে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। গুলি করে নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যার পাশাপাশি তারা এখন সীমান্ত থেকে বাংলাদেশী নাগরিকদের ধরে নিয়ে গিয়ে বেদম মারধরসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এমনকি হাত-পায়ের রগ কেটে সীমান্ত সংলগ্ন নদীতেও ফেলে দেয়া হচ্ছে বলে সীমান্তের নাগরিকরা অভিযোগ করেছেন।

সিলেট সীমান্তে যৌথ জরিপ কাজে ভারতের বাধা : বিভিন্ন সীমান্তে সহস্রাধিক একর বাংলাদেশের জমি দাবি ভারতের

জৈন্তাপুর (সিলেট) প্রতিনিধি

সিলেটের জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট সীমান্তে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমিশন ২য় পর্যায়ের জরিপ কাজে বাধা দিচ্ছে ভারত। ডিবির হাওর সীমান্তে ৫৫ একর ৩০ শতক এবং একই সুরে পাদুয়া সীমান্তে ৩২০ একর বাংলাদেশের ভূমি ভারতের বলে দাবি করছে ভারতের জরিপ টিম। তবে তারা কিসের বলে এ ভূমি দাবি করছে সে ব্যাপারে কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে পারেনি বাংলাদেশের টিমকে। এ নিয়ে একপর্যায়ে দু-দেশের জরিপ টিমের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে ভারত জরিপ কাজে বাধা দেয় এবং ভূমি জরিপ না করে বাংলাদেশের টিম চলে আসে। জরিপ কাজ চলা অবস্থায় উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে।
সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তভূমি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে সমস্যা হচ্ছিল। জোর করে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে ভারতীয় নাগরিদের মাছ ধরে নিয়ে যাওয়া, জমির ফসল কেটে নেয়া, সীমান্ত থেকে বাংলাদেশী নাগরিকদের ধরে নিয়ে হত্যা করা, গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিল বাংলাদেশী সীমান্ত নাগরিকরা। এ নিয়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে একাধিক বার গোলাগুলি হয়, যার ফলে শতাধিক বাংলাদেশী নাগরিক আহত হন।
এ ঘটনায় বিজিবির মহাপরিচালক ও সিভিল প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা সাপেক্ষে জরিপ কাজের মাধ্যমে সীমানা চিহ্নিত করার আশ্বাস দেন এবং সীমান্তবাসীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার কথা বলেন। এই আলোকে গত ১৩ ডিসেম্বর গোয়াইনঘাট সীমান্ত থেকে কানাইঘাট সীমান্ত পর্যন্ত যৌথ জরিপ কাজ শুরু হয়।
ওই উপজেলার সীমান্তে ভারতীয়রা বাংলাদেশের প্রায় সহস্রাধিক একর ভূমি তাদের বলে দাবি করে। এতে কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে পারেনি ভারত। কিছুদিন জরিপ কাজ চলার পর ভারতীয়দের বাধার মুখে বন্ধ হয়ে যায় জরিপ কাজ।
সর্বশেষ গতকাল ৫ এপ্রিল উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে আলোচনার পর পাদুয়া সীমান্তের ১২৭০ নং পিলার ও ডিবির হাওর ১২৮৪নং পিলার থেকে সীমান্তে যৌথ জরিপ কাজ শুরু হয়। ডিবির হাওরে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফজলুল হক, ভূমি জরিপ রেকর্ড অধিদফতরের চার্জ অফিসার আবদুল কাদের, সার্ভেয়ার মো. ইব্রাহিম খলিল ও মোকাদ্দেছ আলী, জৈন্তাপুর ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার মোস্তফা কামাল ও দেলোয়ার হোসেন এবং ভারতের পক্ষে মেঘালয়ের সহকারী পরিচালক শ্রী মারইন, ক্যাম্প অফিসার শ্রী এলিন, সার্ভেয়ার শ্রী এ ই এল ল্যান্ড উপস্থিত ছিলেন। পাদুয়া সীমান্তে বাংলাদেশের পক্ষে সিলেটের এডিসি জেনারেল শামীম আল রাজী, কানুনগো আজহার এবং ভারতের পক্ষে সহকারী পরিচালক সাং প্লিয়াং ও সার্ভেয়ার তরুণ মারক উপস্থিত ছিলেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় উভয় স্থানে জরিপ কাজ করতে গেলে ভারতীয় জরিপ টিম ডিবির হাওর সীমান্তে ৫৫ একর ৩০ শতক এবং পাদুয়া সীমান্তে ৩২০ একর বাংলাদেশের হাজার গজ অভ্যন্তরে দাবি করে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জরিপ টিম প্রমাণপত্র দেখতে চাইলে কোনো ধরনের প্রমাণপত্র ভারতীয়রা দেখাতে পারেনি। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ভারতীয়রা জরিপ কাজে বাধা দেয় এবং উচ্চপর্যায়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে জরিপ কাজ হবে কিনা তা ডিবির হাওরে আগামী ৭ এপ্রিল ও পাদুয়ায় ৬ এপ্রিল সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানায়। ভারতীয়দের বাধার মুখে বাংলাদেশী জরিপ টিম জরিপ কাজ না করে চলে আসে।
এ ব্যপারে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফজুলল হকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ভারতীয়রা সীমান্ত পিলার অতিক্রম করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্যায়ভাবে কোনো কাগজপত্র ছাড়াই ভূমি দাবি করছে, যা আমরা কোনোমতেই মানতে রাজি না হওয়ায় তারা জরিপ কাজ করতে বাধা দেয়। তবে আগামী ৭ এপ্রিল জরিপ কাজ হবে কিনা তারা জানাবে। উভয় দেশের জরিপ টিম কাজ করার সময় বিজিবি ও বিএসএফকে সীমান্তে সতর্কাবস্থানে দেখা যায়।

পানি আগ্রাসনের শিকার বাংলাদেশ

আলাউদ্দিন আরিফ

বিশ্বের সর্ববৃহত্ মরুভূমি সাহারা একসময় ছিল ছোট ছোট নদী ও হ্রদবিশিষ্ট শস্যশ্যামল প্রান্তর। রোমান সাম্রাজ্যের শস্যভাণ্ডার ছিল এই সাহারা অঞ্চল। কিন্তু লোনা পানির আগ্রাসনে সাহারা আজ বিশ্বের বৃহত্তম মরুভূমি। ভারত আগ্রাসন চালিয়ে মিঠা পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রাখলে এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা লোনা পানির অবাধ বিস্তার দূরভবিষ্যতের কোনো একসময়ে বাংলাদেশকেও সাহারা মরুভূমির ভাগ্যবরণ করতে হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারতের একতরফা পানি আগ্রাসনের শিকার হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদীর ৪২টিতে বাঁধ দিয়েছে ভারত। এসব বাঁধের ফলে লবণাক্ততা বাড়ায় এখনই ২০ ভাগ জমি অনাবাদি থাকছে এবং আরও ৩০ ভাগ জমিতে ফসল উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ভারত আসামের ধুবরী এলাকায় ব্যারাজ নির্মাণ করে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ ও আন্তঃনদী অববাহিকা সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত গ্রীষ্ম ও বর্ষা উভয় মৌসুমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়েছে। মেঘনার উজানে বরাক নদীতে কার্যকর করছে টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের নদীমাতৃক পরিচয়টুকুও শুধু হারিয়ে যাবে না, পরিণত হবে মরুভূমিতে।
ভূ-প্রকৃতিগতভাবে বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ অঞ্চল। এর তিন দিকে ভারত ও মিয়ানমার আর একদিকে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের জোয়ার-ভাটার টানে সাগর থেকে ঊঠে আসে লোনা পানি। এই লোনা পানিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসা প্রতিরোধ করে উজান থেকে আসা নদ-নদীগুলোর মিঠা পানি। বাংলাদেশের প্রায় সব নদ-নদীর পানিপ্রবাহের মূল উত্স সীমান্ত নদী।
দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি অববাহিকা বাদে গঙ্গা-পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা এই তিন নদীর অববাহিকায় বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতের একতরফা পানি আগ্রাসনে দেশের সব কয়টি অববাহিকার নদ-নদীগুলো শুকিয়ে পরিণত হয়েছে মরাগাঙে। শুকনো মৌসুমে দেশের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোকে মনে হয় প্রকৃতির ক্ষতচিহ্ন। এগুলোতে এখন চাষ হয় ধান, গম, আখ ও কলাসহ নানা ফসলের। দক্ষিণের নদীগুলোতে জোয়ারে পানি আসে, ভাটায় নামে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানিবিজ্ঞান জুন ২০০৫-এ প্রকাশিত সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি। এর মধ্যে অভিন্ন নদী (আন্তর্জাতিক) ৫৭টি। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ৫৪টি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ভারত থেকে, আর ৩টি এসেছে মিয়ানমার থেকে।
সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে রাজশাহী, পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম হয়ে শেরপুর সীমান্ত পর্যন্ত অভিন্ন নদীগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র বাদে সব কয়টি নদীতে বাঁধ দিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহার চলছে। এই অভিন্ন নদীগুলো হচ্ছে রায়মঙ্গল, ইছামতি-কালিন্দি, বেতনা-কোদালিয়া, ভৈরব-কোবাদাক (কপতাক্ষ), মাথাভাঙা, গঙ্গা, পাগলা, আত্রাই, পুনর্ভবা, তেঁতুলিয়া, ট্যাঙ্গন, কুলীক, নাগর, মহানন্দা, ডাহুক, করতোয়া, তালমা, ঘোড়ামারা, দেওনাই-চাড়ালকাটা-যুমেনেশ্বরী, বুড়িতিস্তা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, জিঞ্জিরাম, চিতলখালী, ভোগাই, নিতাই, সুমেশ্বরী, যাদুকাটা রক্তি নদী। নেত্রকোনা থেকে সুনামগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা সুরমা ও কুশিয়ারার মূল নদী বরাক বাদে সব কয়টি নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। এই এলাকা দিয়ে আসা নদী জালুয়াখালী, ধামালিয়া, নয়াগাং, উমিয়াম, ধলা, পিয়াইন, সারি গোয়াইন, সোনাই বরদল, জুরি, মনু, ধলাই, গোপাল-লংলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হাওরা, বিজনী, সালদা, গোমতী, কাকরি-ডাকাতিয়া ও সোলোনিয়ায় বাঁধ ও স্লুইচগেট নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ সম্পন্ন হলে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ ও একতরফাভাবে প্রত্যাহারের সুযোগ পাবে ভারত। মুহুরী ও ফেনী নদীতে বাঁধ দেয়া না হলেও বড় বড় পাম্প বসিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের সঙ্গে তিনটি নদী হচ্ছে সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও নাফে কোনো বাঁধ নির্মাণের খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এসব বাঁধের কারণে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে ভাটির বাংলাদেশে। অধিকাংশ সীমান্ত নদীর উজানে বাধার কারণে শুকনো মৌসুমে প্রবাহবিহীন হয়ে পড়ে অধিকাংশ নদী। বর্ষায় স্লুইসগেটগুলো খুলে দিলেই দুই কূল ছাপিয়ে বন্যা ও ঢল দেখা দেয়।
ভারতের পানি আগ্রাসনের বড় একটি নমুনা ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল আস্তে আস্তে মরুময়তার দিকে চলে যাচ্ছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর পশ্চিম প্রান্তে যেখানে পদ্মা-মহানন্দা মিলিত হয়েছে সেখান থেকে রাজশাহী শহর, চারঘাট হয়ে হার্ডিঞ্জ সেতু পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে বিশাল বিশাল বালুচর। পদ্মা তীরবর্তী মানুষ জানায়, গত বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি ছিল মাত্র কয়েকদিন। তারপর থেকে চর জাগতে শুরু করে এবং এখন পদ্মাজুড়ে শুধু ধু-ধু বালুর চর আর চর। পানি সঙ্কটের কারণে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ গড়াই কপতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প।
গত ৩৮ বছরে এ প্রবাহ শুধু কমেছে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি হয়। কিন্তু এতে তেমন কোনো সুফল আসেনি। যদিও যৌথ নদী কমিশন বরাবরই বলছে বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী পানি পাচ্ছে। চলতি মার্চের প্রথম ২০ দিনে বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি পেয়েছে বলে যৌথ নদী কমিশন জানিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের চোখের সামনেই বড়াল, মরা বড়াল, নারদ, মুছাখান, ইছামতি, ধলাই, হুড়াসাগর, চিকনাই, নাগর, গড়াই, মাথাভাঙা, ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, বেতাগ, কালীকুমার, হরিহর, কালীগঙ্গা, কাজলা, হিসনা, সাগরখালী, চন্দনা, কপোতাক্ষ, বেলবাত নদী দিনে দিনে মরাগাঙে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এরই মধ্যে ১৩টি নদীর অস্তিত্ব বিলীনের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের হিসাবে রায়মঙ্গল, কালিন্দি, বেতনা-কোদালিয়া, পাগলা, ট্যাঙ্গন, কুলিক, তেঁতুলিয়া, ঘোড়ামারা, তালমা, দেওনাই, চিনাখালী, কোনী, সালদা, বিজনী, হাওড়া, সোনাই, সুতাং, খোয়াই, লংগলা, ধলাই, মনু, জুরি, সোনাইবড়দাল, নিতাই ও ভোগাই নদীর অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের অন্যতম নদী তিস্তা ও বুড়ি তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। তিস্তা ব্যারাজের ভাগ্য ঝুলে গেছে গজলডোবায়। সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে বা উদ্বৃত্ত হিসেবে যে পানি আসে তা দিয়েই চলে তিস্তা ব্যারাজ।
পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, শুষ্ক মৌসুমে দেশের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে পানির অভাবে নদীগুলো যখন মরা গাঙ, নদীর বুকে ধু-ধু বালুচর, পাম্প বসিয়েও পানি তোলা সম্ভব হয় না; ঠিক ওই সময় সিলেট অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে অকাল বন্যা। উজান থেকে নেমে আসা আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে প্রতি বছরই হাজার হাজার একর জমির ফসল ধ্বংস হয়।
মেঘনায় পানি প্রবাহের মূল উত্স বরাক নদী। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসীদ সীমান্তে বরাক দুটি স্রোতে ভাগ হয়ে সুরমা-কুশিয়ারা নাম নিয়েছে। অমলসীদের ১০০ কিলোমিটার উজানে মণিপুর রাজ্যের টিপাইমুখ নামক স্থানে বরাক নদীতে বাঁধ নির্মাণ প্রায় সম্পন্ন করে এনেছে ভারত। টিপাইমুখে ১৬৩ মিটার উঁচু বাঁধ তৈরি করে বরাক ও তার উপনদীগুলোর মিলিত প্রবাহের গতিরোধ করে ৩০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার তৈরি করা হবে। টিপাইমুখ বাঁধের ভাটিতে আসামের কাছার জেলার ফুলেরতল নামক স্থানে একটি বড় বাঁধ তৈরি করে বরাক নদীর পানি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ফলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী মোহাম্মদ আকতারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পানি আগ্রাসনের ফলে মহাবিপর্যয়ে পড়বে বাংলাদেশ। একসময়কার শস্যশ্যামল সাহারা অঞ্চল যেভাবে লোনা পানির আগ্রাসনে মরুভূমি হয়েছে তেমনি দূরভবিষ্যতে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডেও ওই ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তিনি বলেন, ফারাক্কার ফলে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, মহানন্দা ও করতোয়া বাঁধের ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ শুরু হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ চালুর প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১৬ জেলায় মরুকরণ শুরু হবে। টিপাইমুখ বাঁধের ফলে ৪ থেকে ৫ কোটির বেশি মানুষ বিপর্যস্ত হবে। এইসঙ্গে ফারাক্কা বাঁধ এবং গঙ্গার উজানে আন্তঃনদী পানি স্থানান্তর প্রকল্পের প্রভাব একত্রিত করলে বাংলাদেশের ৬০ ভাগ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে।
বিশিষ্ট পানিবিজ্ঞানী জাতিসংঘের সাবেক ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যানার ড. এসআই খান বলেন, ভারতের অংশে ব্রহ্মপুত্রের প্রায় সব কয়টি উপনদীতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করেছে ভারত। গঙ্গার উপনদীগুলোতেও বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। গঙ্গা, তিস্তা, গোমতী, ধরলা, দুধকুমারসহ অন্যসব অভিন্ন নদী থেকে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় বিপর্যয় নেমে এসেছে ভাটির বাংলাদেশে।
বাংলাদেশকে বাঁচাতে প্রধান ৩টি নদী অববাহিকার উপনদী ও শাখানদী নিয়ে আলাদা ৩টি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেন ড. এসআই খান। তিনি বলেন, গঙ্গা ও এর উপনদীগুলো নিয়ে নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে একটি কমিশন, ব্রহ্মপুত্রের পানি বিষয়ে চীন, ভারত, ভুটান ও বাংলাদেশ এবং মেঘনার পানি বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলাদা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এসব কমিশন কার্যকর করার জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংককে নিশ্চয়তা বিধানকারী (গ্যারান্টার) হিসেবে রাখতে হবে। বিশ্বের কার্যকর অন্য নদী কমিশনগুলোর আলোকে আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী প্রধান ৩ নদীর অববাহিকাভিত্তিক ৩টি কমিশন গঠন ও এগুলো কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পাবে। বেঁচে যাবে বাংলাদেশের নদীগুলো। এর মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও চীন সবাই লাভবান হবে

Tuesday, 12 April 2011

চাতলাপুর স্থলবন্দরে পরিবহন শ্রমিকদের পিটিয়েছে বিএসএফ : প্রতিবাদে আমদানি-রফতানি বন্ধ













মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
বিএসফের একটি দল মৌলভীবাজারের চাতলাপুর স্থলবন্দরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে ৩ পরিবহন শ্রমিককে পিটিয়ে ও রাইফেলের বাঁট দিয়ে মেরে মারাত্মক আহত করেছে। এ সময় তারা ট্রাক শ্রমিকদের টাকা-পয়সাও ছিনিয়ে নেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ব্যবসায়ীরা চাতলাপুর স্থলবন্দরে অনির্দিষ্টকালের জন্য আমদানি-রফতানি বন্ধ করে দিয়েছেন।
মৌলভীবাজারের চাতলাপুর স্থলবন্দরের ভারতীয় অংশের কৈলাসহরের বৌলাপাশা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই ব্যবসায়ীর মধ্যে গতকাল দুপুরে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। বাংলাদেশের ট্রাক শ্রমিকরা জানান, এ সময় সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ক্যাম্প কমান্ডার আর কে চাকমার নেতৃত্বে ১৫ থেকে ১৬ জনের বিএসফের একটি দল বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। এ সময় তারা বাংলাদেশী ইটবাহী ট্রাকচালক ফারুক মিয়া, আসিক মিয়া ও হেলপার মো. সেলিম মিয়ার ওপর আকস্মিক হামলা চালায়। তাদের বেদড়ক পেটাতে থাকে। ট্রাক শ্রমিকদের অভিযোগে জানা গেছে, এই সময় দু’জন বিজিবি সদস্য বিএসএফকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকতে সহযোগিতা করে। তাদের সামনেই বাংলাদেশীদের মারধর করা হয়।
বিজিবি নায়েক জালাল উদ্দীন ও সদস্য বাবুল আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, ১৮৬৩ নম্বর সীমান্ত খুঁটির ওপারে ভারতীয় দুই ব্যবসায়ীর লোকজনের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। বিষয়টি বুঝে উঠার আগেই বিএসএফ সদস্যরা অতর্কিতে বাংলাদেশ অংশেঢুুকে পড়ে এবং বাংলাদেশী তিন পরিবহন শ্রমিককে মারধর করতে থাকে। এ সময় বাংলাদেশী শ্রমিক ও বিএসএফের মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হলে তিনি অসহায় শ্রমিকদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। পরে বিএসএফের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বিএসএফের মারপিটে আহত বাংলাদেশী ট্রাকচালক ফারুক মিয়া ও আসিক মিয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা ভারতীয় এক ব্যবসায়ীর ইট জিরো পয়েন্টে নামানোর সময় আকস্মিকভাবে বিএসএফ সদস্যরা তাদের ওপর হামলা চালায়। ট্রাকচালক ফারুক মিয়া জানান, ট্রাক শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য তিনি ও হেলপার মো. সেলিমের কাছে থাকা ২০ হাজার টাকা বিএসএফ সদস্যরা কেড়ে নিয়েছে।
দিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরা গতকাল সকাল সাড়ে ১১টা থেকে চাতলাপুর স্থলবন্দরে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছেন।
চাতলাপুর চেকপোস্টের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা এএসআই কবির হোসেন লোদী জানান, ইমিগ্রেশন কার্যক্রম দুপুর থেকে বন্ধ করে দেয়া হলেও পরে বেলা ২টার পর তা আবারও চালু হয়। এ ব্যাপারে বিজিবি ১৪ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল নূরুল হুদা জানান, বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা বিএসএফের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরব