Sunday 27 March 2011

সীমান্তে সাড়ে ৯শ’ হত্যার পরও সরকার বলছে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়নি : মৃত্যু ভয়ে নাম হয়েছিল ফেলানী : ভাইবোনকে স্কুলে ভর্তি











জাহেদ চৌধুরী ও ইউনুছ আলী আনন্দ
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ) গত ১০ বছরে প্রায় সাড়ে ৯শ’ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। কখনও ধানক্ষেতে গুলি করে কৃষককে মেরেছে। কখনও নৌকার মাঝিকে কিংবা পাথর কোয়ারির শ্রমিককে। শিশু-কিশোর-নারীরাও বিএসএফের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি। আর গরু ব্যবসায়ীরা প্রায়ই রাতের অন্ধকারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কখনও এসব হত্যাকাণ্ডের জোরালো প্রতিবাদ করেনি। সরকার কখনও বলছে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এও বলা হচ্ছে, এসব ঘটনা দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না। যেমনটি ঘটেছে গত জানুয়ারিতে ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীকে খুব কাছ থেকে ঠাণ্ডামাথায় গুলি করে হত্যার পর। কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানীর লাশ বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের বিবেককে নাড়া দিলেও সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, এটি একটি আকস্মিক ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যা প্রতিবেশী দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলেনি। যদিও ওয়াকিবহাল মহল বলছেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল সীমান্তের পর ভারত বাংলাদেশ সীমান্তেই কেবল নির্বিচারে এভাবে বেসামরিক মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে। ফেলানী হত্যার পর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে খবর হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়েছে।
শুধু ফেলানী নয়, এভাবে গত ১০ বছরে সীমান্তে ৯২২ জন বাংলাদেশীকে হত্যার রেকর্ড রয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে। রয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে নির্যাতনের রেকর্ড। বিএসএফের হাতে হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনার বিস্তারিত লোমহর্ষক বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় পত্রিকায়। সরকারও মাঝে মধ্যে মৃদু গলায় এসবের প্রতিবাদ করেছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তুলেছে সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের এসব ঘটনা। কিন্তু ভারত এতে কর্ণপাত করেনি। গত ৭ জানুয়ারি প্রত্যুষে ১৫ বছরের বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীকে কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ খুব কাছ থেকে ঠাণ্ডামাথায় গুলি করে হত্যা করে তার লাশ ৫ ঘণ্টা ঝুলে রেখেছিল। দু’দিন পর লাশ ফেরত দিলেও বাংলাদেশ সরকার আর দশটি সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের মতো এটাকে চাপা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় পত্রিকার সৌজন্যে আমার দেশ এবং নয়াদিগন্তে ফেলানীর ঝুলে থাকা লাশের ছবি প্রকাশের পর বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় নাড়া দিয়েছে এ ঘটনা। সরকারও ১০ দিনের মাথায় অনেকটা বাধ্য হয়ে ভারতীয় দূতকে ডেকে এর মৃদু প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু ফেলানীর মা-বাবাসহ দেশবাসী এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়েছে। ক্ষতিপূরণ চেয়েছে। অথচ সরকার এ নিয়ে নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। ভারতীয় আইনে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার অপরাধে শাস্তি যেখানে মাত্র ৩ মাস কারাদণ্ড সেখানে নিষ্পাপ একটি শিশুকে (আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে হলে শিশুর সংজ্ঞায় পড়ে) হত্যায় বিচার চাইতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ এরই মধ্যে খুনি বিএসএফ সদস্যদের বিচার দাবি করেছে। ক্ষতিপূরণ চাইতে বলেছে বাংলাদেশ সরকারকে। এমনও কথা উঠেছে যে, সীমান্তে পাকিস্তান কিংবা চীনের কোনো নাগরিককে এভাবে হত্যা করে কী ভারতের পক্ষে এভাবে নির্ঝঞ্ঝাট বসে থাকা সম্ভব হতো।
বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফেলানী নয়, এ যেন ঝুলে ছিল বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মানুষকে বিনা কারণে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার পরও এর বিচার তো দূরের কথা জোর গলায় আমাদের সরকার প্রতিবাদ পর্যন্ত কেন করেনি। ঘটনার ১০ দিন পর খোদ ভারত ও বাংলাদেশের দু’একটি পত্রিকায় এ নিয়ে হৈ চৈ শুরু হলে সরকার নামমাত্র প্রতিবাদ করে। সংশ্লিষ্ট খুনি বিএসএফ সদস্যদের প্রত্যাহারের মধ্যেই বিষয়টি চাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। প্রশ্ন উঠেছে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সম্পর্ক যেখানে খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ বলে দাবি করা হয়, সেখানে সীমান্তে এভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কেন এভাবে চাপা পড়ে যাবে?
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বেসামরিক লোক খুন হচ্ছে। পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বা বিএসএফ। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন ও মানবাধিকারের কোনো তোয়াক্কা করছে না তারা। কখনও কখনও সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকেও মানুষ খুন করছে বিএসএফ। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১০ সালে বিএসএফ সীমান্তে ৭৪ বাংলাদেশী নাগরিক খুন করেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্তে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীর হাতে এত নাগরিক খুন হওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানের সীমান্ত রয়েছে। এ তিন দেশের সীমান্তেও বিএসএফ এত খুন করে না। বাংলাদেশ সীমান্তেই তারা প্রতিনিয়ত খুন করছে।
বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের মতে, সীমান্ত অতিক্রম করছে বলে কাউকে মেরে ফেলার বিধান পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। সীমান্ত অতিক্রমের অপরাধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ নিজ দেশের আইনের হাতে ন্যস্ত করাই হচ্ছে বিধান। আইন অনুযায়ী আদালত অপরাধ প্রমাণসাপেক্ষে দণ্ড দেবেন। দেখামাত্রই গুলি করে মেরে ফেলা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
ফেলানীর হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তিনি সমালোচনা করেছেন ভারতীয় মানবাধিকার কর্মীদের। বলেছেন, তারা সেখানকার আদালতে এ নিয়ে মামলা করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। বাংলাদেশের হাইকোর্ট বহু বিষয়ে জনস্বার্থ মামলায় হস্তক্ষেপ করলেও ফেলানী হত্যাকাণ্ড নিয়ে করা রিট হাইকোর্টে ঠেকেনি।
গত ১০ বছরে ৯২২ জন বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফের হাতে খুনের রেকর্ড : ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্ববর্তী ১০ বছরে ৯২২ জন বাংলাদেশীকে বিএসএফ হত্যা করেছে বলে রেকর্ড রয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হাতে। এছড়া গত দু’মাসও রেকর্ডে স্থান পায়নি এমন ঘটনা মিলে প্রায় সাড়ে ৯শ’ বাংলাদেশী হত্যা করেছে বিএসএফ।
এর মধ্যে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের অনুসন্ধান অনুযায়ী গত এক বছরে বিএসএফের হাতে খুন হওয়া ৭৪ বাংলাদেশী নাগরিকের মধ্যে ২৪ জনকে নির্যাতন এবং ৫০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ২০১০ সালে আরও ৭২ জন বিএসএফের হাতে আহত হয়েছেন। বিএসএফের হাতে আহত ৭২ জনের মধ্যে ৩২ জন নির্যাতিত ও ৪০ জন গুলিবিদ্ধ হন। একই সময়ে ৪৩ জন বাংলাদেশী বিএসএফের হাতে অপহৃত হয়েছেন। সিলেটের জৈন্তা সীমান্তে দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশী ভূমি। এ নিয়ে কয়েক দফা উত্তেজনা দেখা দেয় জৈন্তা সীমান্তে। এ সময় বিএসএফ গুলি করলেও বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষীদের গুলি ছুড়তে নিষেধাজ্ঞা ছিল উপর থেকে।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, ২০০৯ সালে ৯৮ জন, ২০০৮ সালে ৬২ জন, ২০০৭ সালে ১২০ জন, ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৪ সালে ৭৬ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০১ সালে ৯৪ জন বাংলাদেশী নাগরিক সীমান্তে খুন হয়েছেন বিএসএফের হাতে। অর্থাত্ গত ১০ বছরে ৯২২ জন নাগরিক বিএসএফের হাতে খুন হয়েছেন।
মৃত্যু ভয়ে নাম রাখা হয়েছিল ফেলানী : ফেলানীকে হত্যার দু’মাস পার হলেও এর বিচার আজও হয়নি। বাবা-মায়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সন্তান মারা যাওয়ার পর ১৫ বছর আগে জন্ম নেয়া এই শিশুটি যাতে বেঁচে থাকে, সে আশা নিয়েই তার নাম রাখা হয়েছিল ফেলানী। বধূ বেশে স্বামীর ঘরে যাওয়ার মতো করে মেয়েকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছিলেন মা জাহানারা বেগম। চারচালা টিনের ভাঙা বেড়ার ঘরে বসে সেই স্মৃতিই রোমন্থন করছিলেন মা জাহানারা বেগম। বলছিলেন, সঞ্চয় যা ছিল সব দিয়ে সোনা রুপার গয়নাও পরিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। কিন্তু তার মেয়ে লাশ হয়ে ফিরেছে নিজের ঘরে। গত ৭ জানুয়ারি প্রত্যুষে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তের দক্ষিণ অনন্তপুর হাজিটারী গ্রামের ৯৪৭/৩এস আন্তর্জাতিক পিলারের কাছে ভারতীয় অভ্যন্তরের খেতাবেরকুটি এলাকায় নির্মমবাবে ঠাণ্ডামাথায় গুলি করে ফেলানীকে হত্যা করে বিএসএফ। ভারতের কুচবিহার জেলার দিনহাটা থানার চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফরা এই হত্যায় জড়িত ছিল।
ফেলানী হত্যার ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের নিন্দা : গত ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে বিএসএফ কর্তৃক ফেলানী হত্যার বিষয়টি উপস্থাপন করতে গিয়ে বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেন, এটি একটি আকস্মিক ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যা প্রতিবেশী দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে কোনো প্রভাব ফেলেনি। প্রায়ই ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশীদের বিএসএফ যেভাবে হত্যা এবং নির্যাতন করছে, তা যে আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএসএফ দুদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও বারবার তারা তা লঙ্ঘন করছে এবং হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু নিয়মিত ঘটে যাওয়া এই বিষয়টিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আকস্মিক ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে সংসদকে অবহিত করেছেন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জাতীয় সংসদে মন্ত্রীর দেয়া এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে যেখানে সরকারের বাস্তবসম্মত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, সেখানে এ ধরনের বক্তব্য সীমান্তে ভারতের প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে সরকারের দুর্বল অবস্থানকে আরও দুর্বলতর করবে বলে অধিকার মনে করে।
শাস্তি মাত্র ৩ মাসের কারাদণ্ড : কেউ বিনা ভিসায় অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধি অনুযায়ী পাসপোর্ট আইন ও ইমিগ্রেশন আইনে অবৈধ সীমান্ত অতিক্রমকারীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতের আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে ৩ মাস কারাদণ্ড। গুলি না করে কাউকে ধরে নিয়ে গেলে ইমিগ্রেশন আইন বা পাসপোর্ট আইন ছাড়াও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে মামলা দেয় ভারতীয় বাহিনী। এতে সহজে কেউ আর বের হয়ে আসতে পারে না। আইন অনুযায়ী বিচারের পর কারা ভোগ করা শেষ হলে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীদের কাছে হস্তান্তর করবে। এ আইনটি ভারতীয় বাহিনী মানছে না। তারা সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে দেখামাত্রই গুলি করে মানুষ মারছে।
অপরদিকে ভারতীয় কোনো নাগরিক সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করলে পাসপোর্ট আইন বা ইমিগ্রেশন আইন অনুযায়ী বিচার হয়। অন্য কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত হিসেবে ধরা পড়লে সঙ্গে সেই অপরাধের অভিযোগ আনা হয় সংশ্লিষ্ট অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর ভয়ে মানুষ এখন জমি চাষ করতেও সাহস পাচ্ছে না। অপরদিকে ভারতীয় নাগরিকরা সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে এসে বিনা বাধায় চাষাবাদ করছে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের পর সীমান্তে গুলি ছোড়া নিষিদ্ধ ছিল। বিডিআর তখন থেকে সীমান্তে আর গুলি চালাতে পারে না।
ফেলানীর লাশ যেভাবে উদ্ধার করা হয় : নাগেশ্বরীর কাশিপুর বিজিবি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার আবদুল জব্বার মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের অনুসন্ধান দলকে জানান, গত ৭ জানুয়ারি আনুমানিক ৬টা ১৫ মিনিটে সংঘটিত ফায়ারের পরপরই অনন্তপুর বিওপির বিজিবি টহলদল ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে বিজিবি সদস্যরা তত্ক্ষণাত্ ফেলানীর লাশ দেখতে পায়নি। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিজিবি টহল দল কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে নিহত ফেলানীর লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। ওইদিন সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া থেকে নিহত ফেলানীর লাশ সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের জন্য ভারতের কুচবিহারে নিয়ে যায়। আনুমানিক সকাল ১১টায় কোম্পানি কমান্ডার নায়েব সুবেদার মো. আবদুল জব্বার নিহতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর লাশ ফেরত চেয়ে বিএসএফের কাছে চিঠি পাঠান এবং তাদের পতাকা বৈঠকে বসার অনুরোধ জানান। কিন্তু বিএসএফের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ৮ জানুয়ারি সকাল ১১টায় বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠক শুরু হয় এবং সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে পতাকা বৈঠক শেষে বিএসএফ প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর নিহত ফেলানীর লাশ হস্তান্তর করে। পতাকা বৈঠকে তার নেতৃত্বে অনন্তপুর বিওপি ইনচার্জ হাবিলদার সানাউল্লাহসহ ১৩ জন বিজিবি সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে বিএসএফের পক্ষে নেতৃত্ব দেন কোম্পানি কমান্ডার রামব্রীজ রায়। এ সময় ভারতীয় পুলিশসহ ৩০ জন বিএসএফ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী থানার এসআই নুরুজ্জামান অধিকারকে বলেন, বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠককালে তিনি উপস্থিত থেকে ভারতীয় সংশ্লিষ্ট পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে লাশ গ্রহণ করেন। পরে এ ব্যাপারে ফুলবাড়ী থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং ০১/১১, তারিখ ০৮/১/১১ ইং সময়-১৩টা ২৫ মিনিট।
কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতলের আরএমও ডা. মো. নজরুল ইসলাম অধিকারকে বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রথমে লাশের ময়নাতদন্ত করেছে। ৯ জানুয়ারি হাসপাতাল লাশটি পাওয়ার পর ৩ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দল গঠন করা হয়। দুপুর ২টায় ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ১টি গুলি ফেলানীর বুকের ডানদিকে বিদ্ধ হয়ে পাঁজরের পেছন দিয়ে বের হয়ে যায় বলে তিনি জানান।
২৭ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুর রাজ্জাক তরফদার অধিকারকে জানান, লাশটি একজন বাংলাদেশীর এটা জানার পর ১৮১ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্ট এসএইচ মানিন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে ৭ জানুয়ারি আনুমানিক ১২টায় টেলিফোনে কথা বলে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশী কিশোরীকে গুলি করে হত্যা করার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং লাশ ফেরত দেয়ার জন্য কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে সহযোগিতা দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। উভয়পক্ষের কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠকে বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফ কর্তৃক সংঘটিত ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয়।
ফেলানী হত্যা ও তার বাবার ভারত যাওয়ার কারণ : ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম (৩৫) জানান, বাবা হাফেজ আলীর মৃত্যুর পর তার বয়স যখন ৯/১০ বছর তখন অভাবের তাড়নায় নাগেশ্বরীর দক্ষিণ রামখানা কলোনিটারী থেকে বিধবা মা আলীজনের সঙ্গে তিনি এবং তার ছোট ভাই আবদুল খলিল ভারতের জলপাইগুড়িতে কাজের খোঁজে যায়। ওই সময় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। জলপাইগুড়িতে তারা বেশ কিছুদিন থাকে। এর মধ্যে মা আলীজন বিবির মৃত্যু হলে তাকে জলপাইগুড়িতে কবর দেয়া হয়। মায়ের মৃত্যুর পর অভাব তাদের গ্রাস করলে দুই ভাই দুই দিকে কাজের সন্ধানে বের হয়। বিভিন্ন স্থানে কাজ করতে গিয়ে ভারতের আলীপুরে ফেলানীর মা জাহানারা বেগমের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। জাহানারা একইভাবে অভাবের তাড়নায় তার দাদীর সঙ্গে আলীপুরে থাকত। নুরুল ইসলামের গ্রামের বাড়ির পার্শ্ববর্তী গ্রাম দক্ষিণ রামখানা বানারভিটার বাসিন্দা জাহানারা হওয়ায় প্রতিবেশী সম্পর্কে এক পর্যায়ে নুরুল ইসলাম ও জাহানারা বেগমের বিয়ে হয়। স্বামী-স্ত্রীর সংসারে দুই মেয়েসন্তান জন্ম নিলেও সন্তান দুটি জন্মের কিছুদিন পর মারা যায়। দুই সন্তানের মৃত্যুর পর স্বামী-স্ত্রী দুজনে আলীপুর ছেড়ে আসামের গোয়ালপাড়া জেলার নিউ বঙ্গাইগাঁও ভাওলাগুড়িতে চলে যান। সেখানে জন্ম হয় ফেলানীর। দুই মেয়ের মৃত্যুর মতো ফেলানীরও মৃত্যু হতে পারে এই আশঙ্কায় তার নাম রাখা হয় ফেলানী। পরে ফেলানীসহ (১৫) আরও ৫ সন্তানের জন্ম হয়। এরা হলো মালেকা খাতুন (১২), জাহানউদ্দিন (১০), আরফান আলী (৮), আক্কাস আলী (৬), কাজলী খাতুন (৪)। নিউ বঙ্গাইগাঁও ভাওলাগুড়িতে একটি মুদির দোকান দিয়ে তাদের ৩ মেয়ে, ৩ ছেলে ও স্বামী-স্ত্রী মিলে পরিবারের ৮ সদস্যের সুখের সংসার চলছিল। অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা সচ্ছল হলে দেশে ফিরে আসবে এই আশা ছিল তাদের। নুরুল ইসলাম দেশে আসবে বলে বাংলাদেশের ভোটার হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র গ্রহণ করে সে। ভোটের সময় এলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ভোট প্রয়োগ করতেন তিনি।
এর মধ্যে মেয়ে ফেলানী বড় হয়ে উঠলে তাকে বাংলাদেশে বিয়ে দেবে এই পরিকল্পনা নেয় তারা। শাশুড়ি হাজেরা বিবির সম্মতিক্রমে ছোটবেলায় কথা দেয়া স্ত্রী জাহানারা বেগমের আপন বড় বোন লালমনিরহাট জেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের চরকুলাঘাট গ্রামের ইদ্রিস আলী ও তার স্ত্রী আনজিনা বেগমের বড় ছেলে আমজাদ হোসেনের (২৫) সঙ্গে বিয়ের ব্যাপার চূড়ান্ত করা হয়। গত বছরের বাংলা ফাল্গুন মাসে নুরুল ইসলাম আসাম থেকে এসে আমজাদ হোসেনের মায়ের সঙ্গে এ বছরের জানুয়ারিতে বিয়ের দিন ধার্য করে। ৯ জানুয়ারি বিয়ের দিন ধার্য অনুযায়ী মেয়ে ফেলানীকে নিয়ে ৬ জানুয়ারি সকাল ১১টায় নুরুল ইসলাম আসাম থেকে রওনা দেয় বাংলাদেশের উদ্দেশে।
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম মেয়েকে নিজ হাতে সাজিয়ে দেন। পরিয়ে দেন হাত, গলা, কান, নাক ও পায়ে স্বর্ণ এবং রুপার অলঙ্কার। হবু জামাই আমজাদ হোসেনের জন্য দুটি আংটি, একটি চেইনসহ মেয়ের হাতখরচের নগদ ১ হাজার ৯০০ ভারতীয় রুপি সঙ্গে দেন। ফেলানীও তার হবু জীবনসঙ্গীর জন্য একটি রুমাল, কিছু গিফ্ট সামগ্রী নিয়ে বাবার সঙ্গে আসে।
দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে তারা রাত ৮টার দিকে আসাম থেকে চৌধুরীহাট বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলে ভারতীয় চৌধুরীহাট খেতাবের কুটি সীমান্তবর্তী গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে দালাল মোশারফ হোসেন (৩৮) ও দালাল বুর্জত আলীসহ (৩০) ৩-৪ জন দালাল তাদের পিছু নেয়। দালালরা তাদের কাঁটাতারের বেড়া পার করে দেয়ার জন্য ৩ হাজার টাকা চুক্তি করে। দালাল মোশারফকে চুক্তির টাকা দেয়ার সময় ফেলানীর বাবা দালালের কাছে প্রতিশ্রুতি নেয় তার মেয়ের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তার কথামতো দালাল মোশাররফ ক্ষতি না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে আশ্বস্ত হন ফেলানীর বাবা। পরে রাত ৯টার দিকে দালাল মোশাররফ হোসেন ফেলানী ও বাবাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে কাঁটাতারের বেড়া পার করে দেয়ার অজুহাতে দালাল মোশারফ ফেলানী ও তার বাবাকে আরও ৩-৪টি বাড়িতে আনা-নেয়া করে। রাত ৯টা থেকে গভীর রাত ৩-৪টা পর্যন্ত এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে টানাহেঁচড়া করায় ফেলানী একটু ঘুমাতে চেষ্টা করেও তা পায়নি। নির্ঘুম রাত কাটানো ও টানাহেঁচড়ায় ক্লান্ত ফেলানী ও তার বাবাকে ৭ জানুয়ারি ভোররাতে ফজরের আজানের সময় ফুলবাড়ীর অনন্তপুর হাজীটারী সীমান্তের আন্তর্জাতিক পিলার ৯৪৭/৩ এসের পাশে ভারতের অভ্যন্তরের চৌধুরীহাট খেতাবেরকুটি এলাকায় নিয়ে আসে দালালরা। ওই এলাকায় কাঁটাতারের ৩ স্তরের বেড়া পার হতে বাঁশের তৈরি ৩টি মই কাঁটাতারের বেড়ায় লাগানো হয়। সেই মই বেয়ে প্রথমে নুরুল ইসলাম, পরে মেয়ে ফেলানী পার হওয়ার সময় চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফ তাদের পিছু নেয়। এক সময় একটি গুলির শব্দ হলে নুরুল ইসলাম ভয়ে পড়ে যান কাঁটাতারের বাইরে। তখন মেয়ে ফেলানী ছিল কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে মইয়ের ওপর দাঁড়িয়ে। নুরুল ইসলাম একটি গুলির শব্দ শুনলেও তিনি আরও একটি কম আওয়াজের গুলি হয়েছে বলে পরে মানুষের কাছে শুনেছেন। হাজীটারী সীমান্তের বাসিন্দা খাইরুল ইসলাম (২৮), মোহাম্মদ আলী (৭০), গোলজার হোসেনসহ (৪৫) আরও অনেকে জানান, ৭ জানুয়ারি ভোর থেকে সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে ছিল ফেলানীর লাশ। ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম মেয়ের হত্যার কথা শুনে সংজ্ঞাহীন হন। সাড়ে ১০টার দিকে ফেলানীর মৃত্যুর খবর পায় তার পরিবার।
ফেলানীর বাবা মা ও ভাইবোনদের বর্তমান অবস্থা : ফেলানীর হত্যার পর থেকে ফেলানীর বাবা ও স্বজনরা ফেলানী হত্যার বিচার, ক্ষতিপূরণ দাবি ও আসামে থাকা স্ত্রী-সন্তানদের ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে দাবি করে এলেও দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থেকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ফেলানীর মা জাহানারা বেগম নিজেই আসাম থেকে তার ৫ সন্তানকে নিয়ে সাড়ে ৭ হাজার ভারতীয় টাকা খরচ করে ফেলানীর মৃত্যুর ৪১ দিন পর বাংলাদেশে আসেন। জাহানারা বেগম আসাম থেকে সরাসরি চৌধুরীহাট বিএসএফ ক্যাম্পে এলে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি চৌধুরীহাট বিএসএফ পশ্চিম রামখানা সীমান্তের ৯৪৮/৫এস আন্তর্জাতিক পিলারের কাছে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পর কুড়িগ্রাম বিজিবির হাতে তাদের হস্তান্তর করে। বর্তমান ফেলানীর মা ও ভাইবোনরা অবস্থান করছেন দক্ষিণ রামখানা কলোনিটারী গ্রামে। বড় মেয়ে ফেলানীর শোক এখনও সামলাতে পারছেন না মা জাহানারা বেগম ও বাবা নুরুল ইসলাম। টিনের চারচালার শেডের একটি শীর্ণ ঘরে ৫ সন্তান ও স্বামী-স্ত্রী ৭ সদস্য মিলে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ঘরে এখনও আসবাবপত্রাদি নেই। মাটিতে বিছানা করে তাদের থাকতে হচ্ছে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ফেলানীর বাড়িতে সরেজমিন এসে সরকারের পক্ষ থেকে তার বাবাকে দেয়া ৩ লাখ টাকা নিয়ে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম পড়েছেন নতুন করে বিপাকে। ৩ লাখ টাকার এরই মধ্যে প্রায় ৩০ হাজারের মতো খরচ হয়েছে। বাকি টাকা দিয়ে তিনি পারছেন না ভাঙা ঘর মেরামত করতে, পারছেন না ব্যবসা করতে। স্থানীয় নাখারগঞ্জ বাজারে একটি চায়ের দোকান কেনার জন্য মনোনিবেশ করলেও পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় তা কেনা হয়নি। নুরুল ইসলাম জানান, আগামী ১১ মার্চ ফেলানীর রুহের মাগফিরাতে দোয়া (চল্লিশা) করার নিয়ত করেছেন। সেখানেও ব্যয় হবে টাকা।
নুরুল ইসলাম জানান, ২৮ ফেব্রুয়ারি ফেলানীর ছোট বোন মালেকা খাতুনকে পার্শ্ববর্তী নাখারগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে দিয়েছেন। গত ৩ মার্চ পার্শ্ববর্তী গোরস্তান রেজিঃ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলে জাহান উদ্দিনকে তৃতীয় শ্রেণীতে, আরফান আলীকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ও আক্কাস আলীকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দিয়েছেন। তার ইচ্ছা এই সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করবেন। ফেলানীর মা জাহানারা বেগম জানান, সরকার আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও আমাদের কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করবে এই আশায় আসাম থেকে চলে আসি। আসামে আমাদের ৪ লাখ টাকার মালামাল ও আসবাবপত্রাদির ক্ষতি হয়। কিন্তু এখানে আসার পর আমরা থাকার জায়গা পাচ্ছি না। মাটিতে বিছানা করে থাকতে হচ্ছে। তিনি সরকারের কাছে ফেলানী হত্যার বিচারসহ ফেলানীর হাত, কান, গলা, নাক ও পায়ে থাকা স্বর্ণ ও রুপার অলঙ্কার ফেরত এবং তার সন্তানদের নিয়ে ভালোভাবে জীবনযাপনের সুযোগ দেয়ার দাবি জানান।
ফেলানীর বিয়ের ঘটনা : ফেলানীর হবু স্বামী আমজাদ হোসেনের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের চর কুলাঘাট গ্রামে গিয়ে জানা যায়, ফেলানীর বয়স যখন ৫ বছর তখন তার মা জাহানারা বেগম ও নানী হাজেরা বিবির সঙ্গে ফেলানী বেড়াতে আসে। তখন নানী হাজেরা ফেলানীর সঙ্গে আমজাদের বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করলে ফেলানীর বড় খালা আঞ্জিনা বেগম ও খালু ইদ্রিস আলী সম্মতি দেন। এরই আলোকে গত ৯ জানুয়ারি আমজাদ ও ফেলানীর বিয়ের আয়োজন করা হয়। আমজাদ হোসেন জানান, তার বিয়ের প্রস্তুতি ছিল ব্যাপক। বিয়ে হবে বলে গার্মেন্ট খাটানো টাকায় সে বাড়ির ভাঙা ঘর থেকে ৪৫ হাতবিশিষ্ট ঘর নির্মাণ করে। সে জানায়, ফেলানীকে ছোটবেলায় একবার দেখা হলেও তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন লালন করেছি দীর্ঘদিন ধরে। বিয়ে করব, সুখের ঘর করব মনের ভেতরের এই স্বপ্নগুলো ধূলিসাত্ করল বিএসএফ। তার মন থেকে একটা জিনিস হারিয়ে গিয়েছে বলে সে জানায়। আমজাদ বলে, ফেলানীর তো কোনো দোষ ছিল না। বিএসএফ তাকে কেন এত নির্মমভাবে হত্যা করল। সে বিএসএফের এই নির্মম হত্যার বিচার চায়। সরকারের কাছে তার দাবি ফেলানীর পরনে থাকা অলঙ্কার ভারত সরকারের কাছ থেকে ফেরত নেয়া ও ফেলানীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক।
ফেলানীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তাদানে বাধা : বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানীর পরিবারকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ‘প্যাট্রিয়টস অব বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেয়া এবং কুড়িগ্রাম জেলার দক্ষিণ রামখানা রহমতিয়া দাখিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে সমাবেশ করার জন্য সাবেক উইং কমান্ডার হামিদ উল্লাহ ও কবি আবদুল হাই শিকদারের নেতৃত্বে একটি দল কুড়িগ্রামে যায়। তাদের সেখানে আসার খবরে কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগ প্রতিবাদ মিছিল বের করে এবং তাদের ঘোষিত সমাবেশের জায়গায় পাল্টা সমাবেশ ডাকলে স্থানীয় প্রশাসন সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে। পুলিশ ও গোয়েন্দারা ‘প্যাট্রিয়টস অব বাংলাদেশ’-এর সংগঠকরা যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন, সেই হোটেল অর্ণব প্যালেস ঘিরে রাখে এবং ফেলানীর বাড়িতে রওনা হওয়ার সময় তাদের বাধা দেয়। কবি আবদুল হাই শিকদার অভিযোগ করেন, তারা অত্যন্ত মানবিক কারণে ফেলানীর পরিবারকে সমবেদনা ও সহমর্মিতা জানাতে এবং আর্থিক অনুদান দেয়ার জন্য কুড়িগ্রামে যান। কিন্তু সেখানে ফেলানীর বাবাকে সরিয়ে রেখে এবং ১৪৪ ধারা জারি করে তাদের উদ্যোগে বাধা দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে একইভাবে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দলকেও ফেলানীদের বাড়িতে যেতে বাধা দেয়া হয়।
অধিকার মনে করে প্রত্যেক নাগরিকের সভা সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে, যা সংবিধানের ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে। গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার পথকে সংকুচিত ও বাধাগ্রস্ত করা থেকে বিরত থাকার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অধিকার

No comments:

Post a Comment