Tuesday 26 February 2013

বৃদ্ধের দাড়ি ধরে টানা সেই ছাত্রলীগ ক্যাডারও লগি-বৈঠার খুনি স্টাফ রিপোর্টার মোফাচ্ছেরে কোরআন ও আলেমদের ডাকা কর্মসূচিতে সশস্ত্র হামলকারী ক্যাডারদের একজন শাহরিয়ার। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তাকে পুলিশ বেষ্টনীতে এক বৃদ্ধের দাড়ি ধরে টানাহেঁচড়া করে কিলঘুষি মারতে দেখা যায়। কিছু মিডিয়ায় ‘জনতার গণপিটুনি’ বলে রাজপথে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসকে বৈধতা দিলেও আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ছাত্রলীগ ক্যাডার শাহরিয়ার (২৮) একজন চিহ্নিত খুনি। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে মানুষ মেরে উল্লাসকারীদের অন্যতম সে। ওইদিন নিহত শহীদের পরিবার ছাড়াও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা আমার দেশকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার তাণ্ডবের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা শাহরিয়ার নিজেও এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করে। এর আগে শাহবাগের কথিত ব্লগারদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বাপ্পাদিত্য বসু ২৮ অক্টোবরের ভয়ঙ্কর খুনি বলে আমার দেশ-এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। শাহরিয়ার রাজধানীর সবুজবাগ থানাধীন বাসাবো-কদমতলা-রাজারবাগ অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৫নং ওয়ার্ড এলাকায় চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিজের শিক্ষাজীবন অষ্টম শ্রেণীতে শেষ হলেও এখন সে আলোচিত ব্লগার ও ছাত্রনেতা। শাহবাগ আন্দোলনে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ছাত্রলীগের নেতৃত্বদানকারী। আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় অছাত্র মোস্তাফিজুর রহমান শাহরিয়ার মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের পদবিধারী নেতাও। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। এলাকার বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে জুয়ার আড্ডা বসায়। তার কথা না শুনলে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করে। সম্প্রতি রাজারবাগ পানির পাম্প সংলগ্ন এলাকায় জমি দখল করতে গিয়ে স্থানীয় জনতার ধাওয়া খেয়ে দলবলসহ পালিয়ে আসতে হয় শাহরিয়ারকে। চাঁদাবাজির অভিযোগে এ সরকারের আমলেই র্যাব তাকে একবার গ্রেফতার করেছিল। পরে ওপর মহলের তদবিরে ছেড়ে দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগে মামলা নেয় না সবুজবাগ থানা পুলিশ। তবে চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছে শাহরিয়ার। তবে ২৮ অক্টোবর পল্টনে সক্রিয় ছিল জানিয়ে এ প্রতিবেদককে সে জানায়, ‘ওইদিন মাঠে ছিলাম। এ ঘটনায় মামলা হইছে, মারও খাইছি। তো তাতে কি হয়েছে।’ তবে সবুজবাগ থানা পুলিশ বলেছে, তারা শাহরিয়ারের ২৮ অক্টোবরের মারামারিতে জড়িত থাকা বা চাঁদাবাজির বিষয়ে কিছুই জানে না। তাদের দাবি, ‘সে খুবই ভালো লোক’। ১৩ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তি দাবিতে বায়তুল মোকাররমের সামনে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে ‘মাওলানা সাঈদী মুক্তিমঞ্চ’। সেদিন ভোরেই বায়তুল মোকাররম, মতিঝিলসহ পুরো এলাকা দখলে নেয় র্যাব ও পুলিশ। সকালে পুলিশ পাহারায় মাওলানা সাঈদীর মুক্তি দাবিতে রাজপথে নামা আলেম, জনতা ও জামায়াত-শিবির কর্মীদের ব্যাপক মারধর করে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। অনেক নিরীহ পথচারীও বর্বর হামলার শিকার হন। সেদিন পুলিশের বেষ্টনীতে থাকা একজন বৃদ্ধ পথচারীর সাদা দাড়ি টেনে ধরে তাকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি মারে অছাত্র ছাত্রলীগ ক্যাডার শাহরিয়ার। কিছু আওয়ামীপন্থী গণমাধ্যমে এসব হামলাকে ‘জনতার হামলা’ বলে বৈধতা দেয়ার প্রয়াস চালানো হয়। তবে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে শাহরিয়ার মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক। ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার চিহ্নিত এ খুনির বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ। কে এই ব্লগারবেশী শাহরিয়ার : ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে প্রকাশ্যে ছুরি দিয়ে মানুষ হত্যার ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। ওইদিনের হামলায় নিহত হন ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শিবির নেতা হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন ও সাইফুল্লাহ মুহাম্মদ মাসুম। এ দুই শহীদের স্বজনরা ছাত্রলীগ নেতা মুস্তাফিজুর রহমান শাহরিয়ার ২৮ অক্টোবর সশস্ত্র হালাকারীদের একজন বলে এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন। তারা জানান, একই এলাকার হওয়ায় মাসুম ও শিপনের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল শাহরিয়ারের। সেই শাহরিয়ারই ওইদিন মানুষ খুনে নেতৃত্ব দেয়। তবে তারা শাহরিয়ারের ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ঘটনার পরদিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হুকুমের আসামি করে একটি হত্যা মামলা (মামলা নং-৬১ (২৯/১০/০৬) হয়। সে মামলার একজন আসামি শাহরিয়ার। এছাড়া শহীদ মাসুম-শিপন স্মৃতি সংসদের পক্ষে বের করা ‘শাহাদাত দেবে মুক্তি’ শীর্ষক বুকলেটে লালবৃত্তে চিহ্নিত করা আছে শাহরিয়ারের ছবি। ছবির ক্যাপশনে লেখা রয়েছে—‘২৮ অক্টোবর ২০০৬ পল্টন মোড়ে এভাবেই এক শিবির কর্মীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায় কদমতলা-রাজারবাগ এলাকার সন্ত্রাসী ২৮ নং ওয়ার্ড (বর্তমান ৫ নং ওয়ার্ড) ছাত্রলীগ কর্মী শাহরিয়ার।’ এর বাইরে ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন বুকলেট ও পত্রিকায় শাহরিয়ারের ছবি রয়েছে। বাসাবো-রাজারবাগ এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা যায়, ২৮ অক্টোবর মানুষ খুনের প্রতিদান হিসেবে ৫ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয় শাহরিয়ারকে। পরে ২০১১ সালে সরকার দলীয় এমপি সাবের হোসেনের আশীর্বাদে ওয়ার্ড সভাপতি থেকে সরাসরি মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক হন। এলাকায় তাকে মদত দেয় ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রী চিত্তরঞ্জন দাশ। ওই এলাকায় চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বেড়ান তিনি। রমজানে দলের ইফতারের টাকা মেরে খাওয়ার অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার সতুরা শরীফে। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বড় ভাই হিরু এলাকার সন্ত্রাসী এবং বোমা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামি। এলাকাবাসী জানায়, রাজারবাগ বাজারে জেরিন মার্কেটে একটি ক্লাব রয়েছে তার, যেখানে প্রতিদিন প্রকাশ্যে জুয়া খেলা চলে। এ জায়গাটি এলাকাবাসীর কাছে মাদকের আখড়া বলে পরিচিত। এখানেই বসে সন্ত্রাসীদের আড্ডা। পুলিশের নাকের ডগায় এসব ঘটলেও পুলিশ অনেকটা দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবুজর গিফারী কলেজের ক্যান্টিনটি নিজের দখলে নেন তিনি। নিম্নমানের খাবার দিয়ে অতিরিক্ত মূল্য নিলেও শিক্ষার্থীরা এর কোনো প্রতিবাদ করতে পারছেন না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সবুজবাগ থানা পুলিশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে শাহরিয়ারের। পুলিশের যোগসাজশেই তিনি এসব অপকর্ম করে বেড়ান। তাই পুলিশের ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে চায় না। গত চার বছরে বিরোধী বহু নেতাকর্মীকে পুলিশ দিয়ে নাজেহাল করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পুলিশের ভয় দেখিয়ে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তিনি। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিশেষ করে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশ নিয়ে হানা দিয়ে তাদের ধরিয়ে দেন। জানতে চাইলে মুস্তাফিজুর রহমান শাহরিয়ার বলেন, দল শাহবাগের আন্দোলনকে সমর্থন করেছে। তাই আমরা গিয়েছি। আমি মূলত ক্রিকেট খেলি। আওয়ামী লীগ ভালো লাগে তাই করি। কোনো রকমের চাঁদাবাািজর সঙ্গে আমি জড়িত নই। দল করে বড় কোনো নেতা হওয়ার খায়েশও নেই। ২৮ অক্টোবর পল্টনে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের কর্মীদের মধ্যে হওয়া মারামারিতে অংশ নিয়েছেন স্বীকার করে তিনি বলেন, ওইদিন মারামারিতে ছিলাম। মামলা হইছে, জেল খাটছি। মাইর খাইছি। ‘আপনি তো ছাত্র না, তারপরও কীভাবে ছাত্রলীগের নেতা’—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অফিসে আমার সিভি দেয়া আছে। দেখে নেবেন আমি ছাত্র কি-না। তিনি বলেন, ‘অভয় বিনোদনী স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি আমি। পরে অন্য স্কুল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করি।’ কোন স্কুল থেকে পাস করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা বলতে পারব না। আপনি দেখি আমার অনেক কিছুই খুঁজে বের করেছেন। এটাও জেনে নিন, পাবেন। এ বিষয়ে সবুজবাগ থানার ওসি বাবুল মিয়ার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অপারেশন অফিসার আহসান হাবিব খান বলেন, তার ব্যাপারে কোনো অভিযোগ আমরা এখন পর্যন্ত পাইনি। আমি তো জানি সে খুবই ভালো লোক। আমি শুধু তার রাজনৈতিক বিষয়গুলো জানি। তিনি বলেন, আমার জানা মতে তিনি ভালো। ক্লাবে জুয়ার আড্ডা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, ক্লাবে কিছু হয় কিনা জানি না। আমি নিজে কখনও ক্লাবে যাই না। অভিযোগ পেলে খোঁজ নিয়ে দেখব। আপনি ওসি সাহেবকেও ব্যাপারটা জানান।

No comments:

Post a Comment