Sunday 17 October 2010

সিরাজগঞ্জ ট্র্যাজেডি : চালক রাজ গোবিন্দ কিছুদূর গিয়ে কেন ট্রেনটি থামিয়ে দিলেন



চালক আছিরউদ্দিনকে বসিয়ে রেখে ট্রেনটি চালাচ্ছিলেন সহকারী চালক রাজ গোবিন্দ। গেটম্যান হীরামন দাস জনসভার মধ্যেই সবুজ পতাকা উড়িয়ে ট্রেনটি সামনে যাওয়ার সঙ্কেত দিলেন। ট্রেনের গার্ড ছিলেন জ্যোতিন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ঘটনার পুলিশি তদন্ত করছেন জিআরপি থানার ওসি বিমল কুমার চাকী। তিনি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রাজ গোবিন্দের সাক্ষ্য নিয়েছেন। মামলার বাদী হয়েছেন জেএন মুখার্জী। কমিটির প্রধান হিসেবে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপক রঞ্জন অধিকারী ঘটনার তদন্ত করছেন। দুর্ঘটনার পর রাজশাহীর অতিরিক্ত কমিশনার স্বপন কুমার রায় ঘটনাস্থলে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন।
চালক আছিরউদ্দিনকে বসিয়ে রেখে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি চালাচ্ছিলেন সহকারী চালক রাজ গোবিন্দ। সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ মুলিবাড়ি রেলগেটের গেটম্যান ছিল হীরামন দাস। গার্ড ছিল জ্যোতিন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। সামনেই বিএনপির জনসভা। লোকে লোকারণ্য। ওই জনসভার মধ্যেই হীরামন দাস সবুজ পতাকা উড়িয়ে ট্রেনটি সামনে যাওয়ার সঙ্কেত দিলেন। রাজ গোবিন্দ হুইসেল না বাজিয়ে ঘণ্টায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেনটি নিয়ে এগোতে থাকলেন সামনের দিকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জনসভা জেনেও হুইসেল না বাজিয়ে দ্রুতগতিতে ট্রেনটি নিয়ে সামনে এগুনোতেই দেখা দেয় বিপত্তি। ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হন ৭ জন। আহত অনেক। এরই মধ্যে চালক গোবিন্দ রাস্তা ফাঁকা পেয়েও ট্রেন চালিয়ে সামনে এগিয়ে নেননি। দুর্ঘটনাস্থলের কিছুদূর গিয়েই হঠাত্ থামিয়ে দেন ট্রেনটি। তিনি জানতেন ট্রেনটি থামালে পড়তে হবে বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে। তবুও ট্রেনটি থামিয়ে দিলেন তিনি। যার ফলে সমাবেশে যোগ দেয়া হতাহতদের সঙ্গী-সাথীদের রোষানলে পড়ে ট্রেনটি। ধরিয়ে দেয়া হয় আগুন।
এই ঘটনায় মৃত্যুর দায় নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে। খালেদা জিয়ার সভাস্থলের পাশে ট্রেনে কাটা পড়ার পর বিএনপির ৭ কর্মী নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায়। এতেও জন্ম দেয় নানা প্রশ্নের। দুর্ঘটনার পর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দায়ী করে মামলা, সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নেতাদের বক্তব্য নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা রহস্যের।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এত বিশাল সমাবেশের খবর জেনেও মুলিবাড়ি গেটম্যান হীরামন দাস ট্রেনটিকে হলুদ পতাকা দেখিয়ে সতর্কতার সঙ্গে চলার পরামর্শ দেননি। সহকারী চালক রাজ গোবিন্দ ট্রেনটি ধীরে না চালিয়ে হুইসেল না বাজিয়ে দ্রুত চালিয়ে নেন। এরই মধ্যে বেশকিছু মানুষ কাটা পড়ে। লোকজন রেল লাইন থেকে হুড়োহুড়ি করে সরে যাওয়ার পর তিনি থামিয়ে দেন ট্রেনটি। এতে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়, উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ট্রেনটি জনসভার ওপর দিয়ে চালিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার সামনে রাস্তা পরিষ্কার পেয়ে সেটি পরিকল্পিতভাবে থামানো হয়। যার ফলে সমাবেশে আসা লোকজনের রোষানলে পড়ে ট্রেনটি। যার থেকে ঝরে যায় ৭টি তাজা প্রাণ। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় ট্রেনটিতে। গত সোমবার তাদের গণপিটুনি ও আগুনে ট্রেনের চালকসহ কয়েকজন আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে র্যাব-পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে চালানো হয় রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও গুলি।
দুর্ঘটনার পর সিরাজগঞ্জ থেকে দমকল বাহিনীর একটি গাড়ি ছুটে এলে জনতা তাদের ওপরও হামলা চালায়। পুলিশ এসময় টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। খালেদা জিয়া পৌনে ৪টায় সমাবেশস্থলে এসে বক্তব্য দেন। তার বক্তব্যকালে মঞ্চের পেছনে প্রায় ১২ গজের মধ্যে লতিফের লাশ ও ট্রেন লাইনে কাটা একটি মানুষের পা পড়ে থাকতে দেখা যায়।
দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ট্রেনে থাকা বগুড়া রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার বেনজিরুল ইসলাম বলেন, তার চোখের সামনে ৪ জন মারা গেছেন। চালক ও গেটম্যান ইচ্ছা করলে ট্রেনটি থামাতে পারতেন। হুঁইসেল বাজিয়ে ধীরেসুস্থে ট্রেনটি নিয়ে পার হতে পারতেন তারা। কিন্তু তা না করে দ্রুত ট্রেন চালানোতেই এই বিপত্তি। কিন্তু যখন একের পর লোক ট্রেনে কাটা পড়ছে তখন ইচ্ছে করলেও ট্রেনটি থামানো সম্ভব হতো না। অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হয়েছে, পরে ট্রেনটি থামিয়ে ট্রেনটিতে নাশকতা চালানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
যদিও বলা হচ্ছে মৃত্যুগুলো হয়েছে দুর্ঘটনায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেটার জন্য দায়ী কারা? রেললাইনের পাশে জনসভার স্থান নির্ধারিত না হলে হয়তো দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। যোগাযোগমন্ত্রী বলেছেন, ‘অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশে বিরোধী দল পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানোয় সিরাজগঞ্জে ট্রেন দুর্ঘটনা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।’
যোগাযোগমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর ওই ঘটনা নিয়ে আরও কতগুলো গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। বিতর্ক হচ্ছে, এটি কি স্রেফ দুর্ঘটনা, না পরিকল্পিত দুর্ঘটনা। এর সঙ্গে দায়িত্বহীনতাও রয়েছে কিনা সে প্রশ্নও উঠেছে। শহীদ জেহাদ দিবস উপলক্ষে বিরোধীদলীয় নেত্রীর জনসভাটি হওয়ার কথা ছিল উল্লাপাড়ায়। বিএনপির সমাবেশ ঘোষণার পর সেটাকে প্রতিহত করতে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ একই স্থনে সমাবেশ ডাকে। পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে তিন কিলোমিটার দূরে সয়দাবাদে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়। ক্ষমতাসীন দল থেকে উল্লাপাড়ায় বিএনপির জনসভা প্রতিহত করার ডাক না দিলে সয়দাবাদকে জনসভার স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হতো না বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা। এরপরও এই জনসভার প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা যোগাযোগ সচিবকেও জানানো হয়। অর্থাত্ খালেদা জিয়ার জনসভার বিষয়টি সম্পর্কে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবগত ছিল। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র সহকারী সচিব জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান। যোগাযোগ মন্ত্রণালরের কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয়নি। আবার রেলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা জানে না জনসভার বিষয়টি। সবকিছুতেই এক ধরনের অস্পষ্টতা। তাছাড়া কেন নির্ধারিত স্থানে বিএনপিকে সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি এর জবাবে কী বলবেন যোগাযোগমন্ত্রী?
প্রশ্ন উঠেছে, স্থানীয় প্রশাসনই বা এমন জায়গায় সমাবেশের অনুমতি দিল কীভাবে, যার ওপর দিয়ে ট্রেন চলে? শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য থাকার কথা পুলিশের। রেল কর্তৃপক্ষেরও সজাগ থাকার কথা যে, হাজার হাজার লোকের মাঝ দিয়ে ট্রেন নিতে হলে আগাম সতর্কতা লাগবেই। যারা দেশ চালান, যারা দল চালান বা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কিংবা ট্রেনের চালক—তাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা ও মানবিকতার ছিটেফোঁটা হলেও থাকা উচিত। অনেকের জানমালের দায়িত্ব তাদের ওপর। এ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে চালানোর ক্ষমতা যতটা উপভোগ করেন, দায়িত্বটা ততটাই ভুলে যান।
জনসভাস্থলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে দুটি রেলস্টেশন থাকায় ট্রেনের গতিবেগ কম থাকার কথা। কিন্তু ট্রেনটির সহকারী চালক রাজ গোবিন্দ দাস বলেছেন, তিনি জনসভার বিষয়টি একেবারেই অবগত ছিলেন না। ফলে স্বাভাবিক গতিতে ট্রেন চালিয়েছেন। এ দিন ট্রেনের চালক আছিরউদ্দিন ট্রেনে থাকলেও তা চালাচ্ছিলেন সহকারী চালক রাজ গোবিন্দ দাস। রাজ গোবিন্দ বলেছেন, ভ্যাকুয়াম পাইপলাইন ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে তিনি ট্রেনটি থামিয়েছেন। লোকগুলো ট্রেনে কাটা পড়ার পর ভ্যাকুয়াম পাইপলাইন ছিঁড়ে গেল, আর সময় পেল না। এটাও প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। ট্রেনটি জনসভাস্থল অর্থাত্ দুর্ঘটনার পর কেন থামানো হয়েছিল তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। কারণ এ ধরনের ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও রেলস্টেশন ছাড়া ট্রেন রাস্তায় থামিয়ে দেয়ার নজির নেই। গেটম্যান হীরামন দাস নীরব থেকেই ট্রেন থামানোর সিগন্যাল দেননি। ট্রেনটি দুর্ঘটনার পর থামানোর ফলে ক্ষুব্ধ জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়। জিআরপি থানার ওসি বিমল কুমার চাকী এরই মধ্যে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রাজ গোবিন্দের সাক্ষ্য নিয়েছেন। এ দুর্ঘটনার পর রেলওয়ের পক্ষ থেকে মামলা হয়েছে। জিআরপি থানার মামলার বাদী হয়েছেন ওই ট্রেনের গার্ড জে এন মুখার্জী। মামলার পর গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়।
এ ঘটনা তদন্তে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপক রঞ্জন অধিকারীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তদন্ত সুষ্ঠু হবে না। কারণ যোগাযোগ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে আগেই মন্তব্য করেছেন। তদন্ত কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানা গেছে। দুর্ঘটনার রাজশাহীর অতিরিক্ত কমিশনার স্বপন কুমার রায় ঘটনাস্থলে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/10/17/49074

No comments:

Post a Comment