Monday 16 August 2010

আওয়ামী লীগের বেপরোয়া এমপিরা

মির্জা মেহেদী তমাল
ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন শাসকদলের কিছু সংসদ সদস্য। সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। শুধু তাই নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী থেকে শুরু করে স্কুলের শিক্ষকদেরও তারা রেহাই দিচ্ছেন না। মারধর করছেন প্রকাশ্যে। কোনো কোনো স্থানে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক এমপি। দলের একাধিক এমপি এভাবে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় সরকারের নীতিনির্ধারকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

বিশেষ করে নুরুন্নবী শাওন এমপির বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারে খুনের ঘটনা ঘটায় বিষয়টি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। সূত্রে জানা গেছে, খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে দল এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন পদাধিকারীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের এমনও বলেছেন, '৯৬ এর সরকারে কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির বেপরোয়া আচরণের চরম মূল্য গোটা দলকে দিতে হয়েছিল। এমনটি ভবিষ্যতে হোক তিনি চান না। এ জন্য অবিলম্বে অসংযত আচরণকারী এমপিদের লাগাম টেনে ধরতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ দিকে সরকারি দলের এমপিদের কার্যক্রম নিয়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাকেও প্রতিবেদন দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ঘনিষ্ঠসূত্র জানায়, বিতর্কিতদের দায়দায়িত্ব যাতে দলের ওপরে না আসে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে ইতোমধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। পাশাপাশি দলীয়ভাবেও বিতর্ক সৃষ্টিকারী সংসদ সদস্যদের একটি তালিকা করতে তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে বেপরোয়া এমপিদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী কঠোর অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভোলা-৩ আসনের এমপি ও যুবলীগ নেতা নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। খোদ রাজধানীর শেরেবাংলা নগর সংসদ ভবন এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবলীগ কর্মী ইব্রাহীমের মৃত্যুর ঘটনায় তার দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ছেন অনেকেই। পুলিশ ইতোমধ্যে তার অস্ত্র ও জিপ গাড়ি জব্দ করেছে। এ দিকে ৩০ জুন আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে আশুলিয়া বাজারসংলগ্ন সেতুর কাছে কর্তব্য পালনের সময় মো. ইলিয়াসউদ্দিন মোল্লাহ এমপি সাভারের ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. শরীফুল ইসলামকে মারধর করেন। এ ঘটনায় সার্জেন্ট শরীফুল ইসলাম ইলিয়াসউদ্দিন মোল্লাহর বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। ঢাকা-৪ আসনের এমপি সানজিদা খানমের বিরুদ্ধে রাস্তার উন্নয়নকাজ বন্ধ রেখে চঁাঁদা দাবির অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর দয়াগঞ্জের একটি সড়কের উন্নয়ন নিয়ে চাঁদা দাবি ঘটনা থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরীর বিরুদ্ধে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি নিয়ে দুর্নীতি ছাড়াও সন্ত্রাসের অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কথা বলায় ভাইস চেয়ারম্যান ফাতেমা মনিরকে মারধর পর্যন্ত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে সারাহ বেগম কবরী বলেন, 'আমি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। আমার দ্বারা কাউকে মারধর সম্ভব?' এ দিকে যশোর-১ আসনের সরকারদলীয় এমপি শেখ আফিলউদ্দিন রবিবার শার্শা থানার ওসিকে পিটিয়েছেন। যুবদল নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নেওয়ায় ক্ষুব্ধ আফিলউদ্দিন এ ঘটনা ঘটান। তাকে মারধরের সময় থানার কয়েকজন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে আফিলউদ্দিন এমপি বলেন, ওসি তার নিজের অপকর্ম ঢাকতে আমার সম্পর্কে কুৎসা রটাচ্ছেন। মারধরের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

দিনাজপুর-৬ আসনের এমপি মো. আজিজুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভিজিএফ কার্ড বিতরণে হস্তক্ষেপ, কর্মীদের মারধর, অসহযোগিতা, দুর্ব্যবহারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। গত বছর অক্টোবরে ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের উপস্থিতিতে সংসদ সদস্য মো. আজিজুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়র। নবাবগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শাহ আলমগীর ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান অভিযোগ করেছিলেন, আজিজুল হক চৌধুরী এমপির নেতৃত্বে এলাকায় ভিজিএফ, কাবিখাসহ বিভিন্ন সরকারি কাজে লুটপাট চলছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের আবদুল ওদুদ এমপি ও তার সহযোগী মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগে মামলা হয়েছে। চলতি বছরের ৯ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতে এ মামলা করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আতাউর রহমান এবং স্থানীয় হাবিবুর রহমান ও মো. আলাউদ্দীন। এ দিকে গত বছর ৩১ ডিসেম্বর ভোর ছয়টা থেকে কঙ্বাজার শহরের প্রবেশমুখ কলাতলীতে পুলিশ গাড়ি তল্লাশি করছিল। বেলা ১২টার দিকে সরকারি দলের এমপি এম এ লতিফ ওই তল্লাশি থেকে ২০ গজ দূরে তার গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট আবদুল আজিজ ও পরে হাবিলদার শামসুল আলমকে ডেকে পাঠান। পুলিশ অভিযোগ করে, লতিফ এমপি ওই দুজনকে তুই-তুকারি করে তল্লাশির কারণ জানতে চান। নিজেকে সরকারি দলের এমপি পরিচয় দিয়ে তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এ ছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে এসে ফুল দিতে গিয়েও পুলিশকে মারধর করেন চট্টগ্রামের আলোচিত এই এমপি।

কঙ্বাজার-টেকনাফ সড়কের কুতুপালং উচ্চবিদ্যালয়সংলগ্ন একটি বিকল সড়ক মেরামত ও ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে ১৬ জুন আবদুর রহমান বদি এমপি নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিমকে মারধর করেন। এর প্রতিবাদে কঙ্বাজার ঠিকাদার কল্যাণ সমিতি জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়ক, সেতু ও কালভার্টের নির্মাণকাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখে। ২৩ জুন এক সমঝোতা বৈঠকে নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিমকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চান এমপি আবদুর রহমান বদি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি বিধি লঙ্ঘন করে একাই ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটির সভাপতি হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ ও সদরের আংশিক) আসনের সরকারদলীয় এমপি আবদুল মান্নান। অথচ সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী একজন এমপি তার নির্বাচনী এলাকায় সর্বোচ্চ চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারেন। এ ব্যাপারে মার্চের প্রথম সপ্তাহে যশোর শিক্ষা বোর্ডে লিখিত অভিযোগও করেছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম। কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারী) আসনের ক্ষমতাসীন দলের এমপি মো. জাকির হোসেন ৬ জানুয়ারি রৌমারী ভূমি অফিসের কর্মচারী মোশাররফ হোসেনকে মারধর করেন। অফিস সহকারী পদে পছন্দমতো প্রার্থীকে নির্বাচিত না করায় সুনামগঞ্জের জয়শ্রী উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সভাপতি এবং জয়শ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আক্কাছ উদ্দিন আহমেদকে মারধর করেছেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। শুধু তাই নয়, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও এমপির মারধরের হাত থেকে রক্ষা পাননি। দলীয় এমপিদের বেপরোয়া আচরণের বিষয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে নিশ্চয়ই দল বিষয়টি দেখবে। তিনি বলেন, দলের ভাবমূর্তি সবার আগে। কারো আচরণ যদি দলের জন্য ক্ষতিকর হয় তাহলে তিনি যত ক্ষমতাধরই হোন না কেন পার পাবেন না।

http://bangladesh-pratidin.com/

No comments:

Post a Comment